রাষ্ট্র যে জুলুম করে- এ নিয়ে কোনো তর্ক নেই। যারা জুলুম করে তারাও যে সেটা জানে না, তা নয়। তবে রাষ্ট্রের ওই জুলুমের চরিত্রটা কী, তা নিয়ে তর্ক আছে; বিশেষ করে জুলুমবাজ রাষ্ট্রকে যারা ভেঙে ফেলে মানুষকে মুক্ত করতে চায় তাদের মধ্যে, সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে।
ব্রিটিশ রাষ্ট্রের শাসনাধীনে অর্থনীতিতে যে সামন্তবাদী শোষণ চালু ছিল- এটা নিয়ে তর্ক নেই। সমাজতন্ত্রীদের ভেতর যাঁরা অগ্রগণ্য সেই কমিউনিস্ট পার্টি সামন্তবাদের কথা বলবে; এটা স্বাভাবিক ছিল; বিশেষ করে এই কারণে যে, অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর। কিন্তু ১৯৪৭-এ ব্রিটিশ যখন চলে গেল তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় কারা এলো এবং তাদের শাসনাধীনে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক শোষণ পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন এলো কিনা- এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা সংগত। প্রশ্ন উঠেছেও। কমিউনিস্ট পার্টিগুলো তখনও মনে করেছে, সামন্তবাদ যে বিদায় হয়েছে, তা নয়; আছে। এমনকি ১৯৫০ সালে যখন জমিদারি ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটল, তখনও জমিদার না থাক; জোতদার ও তাদের সহযোগী মহাজনদের শোষণ যে রয়ে গেল; এটা তাঁরা বলতে চেয়েছেন।
ওদিকে রাষ্ট্র কিন্তু এগোচ্ছিল পুঁজিবাদের পথেই এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা যারা পেয়েছে, পেয়ে পূর্ববঙ্গকে যারা তাদের উপনিবেশ হিসেবে কায়েম করে রাখতে চেয়েছিল; তাদের মধ্যে ভূস্বামীরা থাকলেও, পাকিস্তানি শাসনামলে যাদের দুর্দান্ত বাড় বেড়েছিল তারা ছিল সামরিক ও বেসামরিক আমলা এবং ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি। এরা কৃষিতে পুঁজিবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল অধিকতর উদ্বৃত্ত লাভের আশায়। কষ্টেসৃষ্টে হলেও পূর্ববঙ্গে একটি বুর্জোয়া শ্রেণি গড়ে উঠছিল। তারা দেখেছে, পাকিস্তানি নামধারী বুর্জোয়ারা তাদের দাবিয়ে রাখতে চেষ্টা করছে। সেটি তারা মেনে নিতে রাজি হয়নি। দু'পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল অবশ্যম্ভাবী। পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে ওই দ্বন্দ্বের যে মীমাংসা হবে- সেটা ছিল একেবারে অসম্ভব। গড়ার পথেই পাকিস্তানের ভেঙে পড়ার এটিই একমাত্র কারণ নয়, তবে একটা বড় কারণ তো বটেই।
শাসনক্ষমতার ব্যাপারে পাকিস্তানের বেলায় যেটা ঘটেছিল, বাংলাদেশের বেলায়ও কিন্তু সেটাই ঘটল। ক্ষমতা চলে গেল বুর্জোয়াদের হাতে। কারণ রাষ্ট্র আয়তনে ছোট হলো ঠিকই; চেহারাতেও বদল হলো, কিন্তু চরিত্রের বদল হলো না। সমাজ বিপ্লব ঘটল না। আমাদের এই রাষ্ট্রে অনেক কিছু বেশ ভালো রকমেই মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু সর্বাধিক মুক্তিপ্রাপ্তি যার ঘটেছে, তার নাম পুঁজিবাদ। বুর্জোয়ারা পুঁজিবাদী শোষণ-শাসনই চায়। পাকিস্তানি বুর্জোয়ারা চেয়েছে; বাংলাদেশি বুর্জোয়ারাও সেটাই চাইছে। এতেই তাদের সুবিধা। পুঁজিবাদ তাই দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে।