ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল বছর চারেক আগে তাঁর এক বক্তব্যে উল্লেখ করেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি ক্রমেই একটি উচ্চতর মাদ্রাসায় রূপ নিচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০ নম্বরের ভর্তি পরীক্ষায় ৮০ নম্বরই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের গড় থেকে নেওয়ার ভ্রান্ত পদ্ধতির উল্লেখ করে তিনি বলেন, মাদ্রাসাগুলো তাদের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতা অত্যন্ত উদারভাবে মূল্যায়ন করে, যা সাধারণত শুরুই হয় ৯০ শতাংশ নম্বর দিয়ে, যেখানে ইংরেজির প্রায় কোনো সংশ্লিষ্টতাই নেই। অথচ সাধারণ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা অনেক পরিশ্রম করেও তার কাছাকাছি পর্যায়ের নম্বর পান না। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অনেক নিম্ন মেধার মাদ্রাসাশিক্ষার্থী দাখিল ও আলিম পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার সুবাদে খুব সহজেই ভর্তি পরীক্ষায় টিকে যাচ্ছেন এবং
এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি ক্রমেই একটি উচ্চতর মাদ্রাসায় রূপ নিতে শুরু করেছে।
অধ্যাপক মেসবাহ কামালের এই উদ্বেগের সঙ্গে দেশের অনেক সচেতন মানুষেরও একাত্ম হওয়ার কথা। কারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এ দেশের মানুষ বাংলাদেশ-সমাজের দর্পণ হিসেবেই গণ্য করে। সেখানে যা ঘটে এবং যা ঘটে না, এ উভয়ই বস্তুত এ দেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজ কোন পথে ধাবিত হচ্ছে, তারই নির্দেশক।
১৯৪৮-৭১ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলনের যে ইতিহাস, তা বস্তুত বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামেরই ইতিহাস, যার সূচনা হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া জিন্নাহর ভাষণের প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে। একইভাবে ১৯৭১-পরবর্তী বাংলাদেশ কোন পথে এগিয়েছে, তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালেই অনেকটা স্পষ্ট হবে। এই মুহূর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে ক্রমেই একটি মাদ্রাসা হয়ে উঠছে, এটি বস্তুত বাংলাদেশ সমাজেরই একটি ধর্মীয় মৌলবাদী সামাজিক শক্তির প্রাধান্যযুক্ত রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়ে ওঠার প্রবণতারই সমান্তরাল ঘটনা।
নিম্ন মেধার মাদ্রাসাশিক্ষার্থীরা শুধু যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই আধিক্য গড়ে তুলছেন তা-ই নয়, একই অবস্থা ঘটছে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অন্যান্য নানা ক্ষেত্রেও। কওমি ও সাধারণ ধারার যেকোনো মাদ্রাসা থেকে ১৬ ও ১৭ বছরের শিক্ষাকাল অতিক্রম করলেই সেখানকার একজন শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সমমানের সনদ পেয়ে যাচ্ছেন। আর এরূপ একটি সনদ হাতে থাকলে তদবিরের জোরে চাকরি পেয়ে যাওয়া, বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানে, এখন খুবই মামুলি ব্যাপার এবং বাস্তবে তা এতটাই ঘটছে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব দখলের মতো বিভিন্ন স্তরের চাকরিবাকরি ও সমাজের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানেও ক্রমান্বয়ে ওই মাদ্রাসা থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের অধিকারেই চলে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্র শুধু যে প্রশ্রয়ই দিচ্ছে তা-ই নয়, অবিরাম পৃষ্ঠপোষকতাও দিয়ে যাচ্ছে। কখনো হেফাজতের সঙ্গে আবার কখনো কওমি মাদ্রাসাপন্থীদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন সেই পৃষ্ঠপোষকতারই প্রামাণ্য দলিল। আর এটা তো সহজেই বোধগম্য যে এ দেশের সংস্কৃতি অনুযায়ী, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পাদিত রাজনৈতিক চুক্তি শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিরই সমতুল্য হয়ে দাঁড়ায়।