রাশিয়া যে পুরোপুরি পুঁজিবাদী হয়ে গেছে তার প্রমাণ ভেতরে-বাইরে সুন্দরভাবে দৃশ্যমান। ভেতরে চলছে স্বৈরাচার, বিরোধীদের নিষ্পেষণ, দুর্নীতি, পরিবেশদূষণ। বাইরে বিক্রি করছে অস্ত্র; মিয়ানমারের সেনাশাসকরা অস্ত্র পাচ্ছে রাশিয়ার কাছ থেকে। শেষমেশ ঘটল ইউক্রেনের ওপর হামলে পড়া।
কারণ ইউক্রেন বশ মানছিল না; পুঁজিবাদে দীক্ষিত হয়ে ইউক্রেনও চাইছিল পুঁজিবাদী দেশগুলোর সঙ্গে মিলেমিশে ‘উন্নতি’ করবে। যোগ দেবে ন্যাটোতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে এবং বন্ধুত্ব গড়ে তুলবে আমেরিকার সঙ্গে। মহামতি পুতিনের তাতে ভীষণ রাগ। ইউক্রেন একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল, ইউক্রেনকে রাশিয়া এখন অনুগত প্রতিবেশী হিসেবে দেখতে চায়, শত্রুদের সঙ্গে হাত মেলানো তার জন্য বড় অপরাধ; তাতে ‘রাশিয়ার নিরাপত্তা’ বিঘ্নিত হওয়ারও আশঙ্কা।
শোনা যাচ্ছিল হামলা করবে। কিন্তু সত্যি সত্যি যে হামলে পড়বে এমনটা মনে হয়নি, বিশেষ করে এ জন্য পুতিন বারবারই বলছিলেন যে আক্রমণের কোনো অভিপ্রায়ই তাঁর নেই। হামলা হলো। রাশিয়া আশা করেছিল ইউক্রেন সরকার দেশ ছেড়ে পালাবে। কিন্তু দেখা গেল তেমন কিছু ঘটছে না। ইউক্রেন লড়ছে। শুধু পেশাদার সেনারাই নয়, দেশের সাধারণ মানুষও পথে নেমে এসেছে। পুতিন আশা করেছিলেন সেখানে একটা পুতুল সরকার বসাবেন। পারলেন না। ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন বিদ্রোহ করতে এবং ক্ষমতা দখল করে নিতে। সেনাবাহিনী উল্টো কাজ করেছে, দেশরক্ষায় ব্রতী হয়েছে। এবং খোদ রাশিয়াতেই যুদ্ধবিরোধীরা বিক্ষোভ করছে। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও শিল্পীরা খোলা চিঠি লিখেছেন। মস্কোসহ ৫৩টি শহরে মানুষ নেমে এসেছে যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। এ পর্যন্ত তিন হাজার জনকে আটক করা হয়ে গেছে। ওদিকে চীনও নীরবে সমর্থন জানাচ্ছে তার একদা শত্রু রাশিয়াকে। সেও পুঁজিবাদী। অন্যদের কাছে তো বটেই, মিয়ানমারের কাছেও সে অস্ত্র বিক্রি করে থাকে। তার আশা, যুদ্ধে রাশিয়া দুর্বল হলে সে প্রবল হবে এবং আমেরিকার মুখোমুখি হওয়ার ব্যাপারে নেতৃত্বের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। ওদিকে আমেরিকা আশা করছে, রাশিয়া এবার ভালোভাবেই জব্দ হবে। এতে তার সুবিধা। পুঁজিবাদীরা যে অসংশোধনীয় রূপে যুদ্ধবাজ, সেটি দুটি বিশ্বযুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে, প্রমাণিত হলো ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলায়ও।
ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার হামলায় একটি ঐতিহাসিক বক্রাঘাতও ঘটেছে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটানোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত (ষড়যন্ত্রও বলা চলে) ইউক্রেনে বসেই রাশিয়া, বেলারুশ ও ইউক্রেনের তিন রাষ্ট্রপ্রধান নিয়েছিলেন; গোপনে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান ব্যক্তি গর্বাচেভকে না জানিয়ে। গোপন চুক্তি সই করার পর গভীর রাতে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপ্রধান তাঁর বন্ধু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে (সিনিয়র) জানিয়েছিলেন খবরটি; রুশ রাষ্ট্রপ্রধান ইয়েলিসন জানান গর্বাচেভকে। টেলিফোনে। সেই ইউক্রেনকে দখল করার জন্যই এখন পুতিনের অভিযান, যে পুতিন একসময় ছিলেন কেজিবির কর্মচারী। বিভিন্ন শহরে যুদ্ধবিরোধী যে বিক্ষোভ হচ্ছে তার ফেস্টুনে পুতিনের ব্যঙ্গচিত্র আঁকা হয়েছে অবিকল হিটলারের মতো করে। পুতিনও একজন হিটলারই। ইতিহাসের কৌতুক এখানেও যে হিটলারের পতন ঘটেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটাতে গিয়েই, আর পুঁজিবাদের ভেতর-বাইরের অন্তর্ঘাত ও আঘাতে সেই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া থেকেই নতুন একজন হিটলার বের হয়ে এলেন। কৌতুকের পেছনে বাস্তবতাটা এই যে হিটলাররা পুঁজিবাদেরই প্রতিনিধি, পুঁজিবাদের ভেতর থেকেই তাঁরা উৎপাদিত। আর সে ক্ষেত্রে হিটলার ও পুতিনের পার্থক্যটা গুণগত নয়, পরিমাণগতই বটে।
পুতিনের হিটলারি আচরণের বিস্তর নিন্দা হচ্ছে। হওয়াটা স্বাভাবিক, হওয়াটা প্রয়োজনীয়ও। পশ্চিমা পুঁজিবাদী বিশ্ব কেবল নিন্দা নয়, মুষ্টিবদ্ধ আস্ফাালন করছে, হুংকারও দিচ্ছে মোটা গলায়। গণমাধ্যমে ইউক্রেনবাসীর মানবিক বিপর্যয়ের কাহিনি ও ছবি আসছে। অর্থনৈতিক অবরোধও জারি করা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমা পুঁজিবাদীদের নৈতিক জোর আছে কি? ওই একই কাজ কি তারা ইরাকে করেনি? হানা দেয়নি কি আফগানিস্তানে? বিধ্বস্ত করে দেয়নি কি লিবিয়াকে? ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে কি পশ্চিমের পুঁজিবাদী বিশ্ব ছিল না? নিয়মিতভাবে ইসরায়েলিরা যে আবদ্ধ ফিলিস্তিনিদের হত্যা করে চলেছে তার প্রতিবাদটা কোথায়?