বন্ধ কারখানায় বাজে না বিশ্বকর্মার ঢাক

দেশ রূপান্তর সৌমিত্র দস্তিদার প্রকাশিত: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৯:২৯

অনেক দিন আগে লিখেছিলাম ট্রেনের সাধারণ কামড়ায় উঠলেই আসল ভারতকে চেনা যায়। আর এক জায়গায়ও এ দেশের হালহকিকত বোঝা যায়। তবে সেখানে আর কজন রোজ যাচ্ছেন। আমার অবশ্য ইচ্ছে আছে একবার ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে পথের ধারের ধাবাগুলোতে এক আধদিন থেকে ভারত কোনোদিকে চলেছে তাই নিয়ে ডকুমেন্টারি করার। ধাবায় ভিড় করা ট্রাক ড্রাইভারদের মতো দেশে কোথায় কী ঘটছে তা খুব কম লোক বলতে পারেন। কিন্তু ট্রেনে উঠে দেশ চেনা, বলাই বাহুল্য অনেক সহজ। ট্রেনে যেতে যেতে বাইরের দিকে তাকালেও বেশ লাগে। এখন বর্ষা যাবে যাবে করছে। পুরোপুরি যেতে সময় লাগবে। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে কল্যাণী বেশি সময়ের পথ নয়। শান্তিপুর লোকাল তুলনায় ফাঁকা। আজ বিশ্বকর্মা পুজোর ছুটি। ফলে ভিড় কম। জানালার ধারের সিটে বসে বাইরে তাকাতে না তাকাতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। আমার সহযাত্রী পাঁচ তরুণের লাগেজ কিঞ্চিৎ বেশি। স্যাক, ঝোলা ছাড়াও মোটাসোটা দুটো বস্তা। আলাপ করে বুঝলাম রানাঘাটে নামবে। বাড়ি সবার বেথুয়াডহরি। আট মাস পরে বাড়ি ফিরছে। কাজ করতে গিয়েছিল দিল্লির কাছে গাজিয়াবাদ। এই বাংলা থেকে যাওয়া শ্রমিকদের একটা কেতাবি নাম আছে। পরিযায়ী শ্রমিক। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রাম, মুর্শিদাবাদ, মালদার বিভিন্ন এলাকায় অধিকাংশ তরুণই আজ নিজের রাজ্য থেকে পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে অন্য রাজ্যে কাজ করতে যান। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির অবস্থা যে ভালো নয়, তা যে কেউ একটু খোঁজ নিলেই টের পাবেন।


ছোটবেলায় সমরেশ বসুর লেখা পড়েছিলাম বলেই বোধ হয় দেড় ঘণ্টার পথটার বেশির ভাগ অঞ্চলের নামগুলো এখনো শুনলেই মনটা কেমন ফুরফুরে লাগে। বেলঘড়িয়া, আগরপাড়া, সোদপুর, টিটাগড়, খড়দহ, নৈহাটি, জগদ্দল, ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রত্যেক স্টেশনে গাড়ি দাঁড়ালেই আমি কেমন ষাটের দশকে পৌঁছে যাচ্ছি। বাইরের আকাশ কেন জানি না আজ বেশ থমথমে। মুখ গম্ভীর। বৃষ্টি হতে পারে। সবুজক্ষেত, আদুল বাচ্চা কোলে মা হাঁটছে। ফিঙে ঝুলছে তারে। ঝলমলে মাছরাঙা খালের জলে শিকারের অপেক্ষায়। এদিকে-ওদিকে কাশফুল দেখতে বেশ লাগে। ট্রেনে ভিড় একটু বেড়েছে। চিৎকার করে রোগা ফেরিওয়ালা ঝালমুড়ি বেচছে। ষাট দশকের এই চব্বিশ পরগনা ছিল শ্রমিক আন্দোলনের গড়। ইঞ্জিনিয়ারিং, চটকল, সুতাকল, হরেক কারখানা। সমরেশ বসুর সাহিত্য ছবির মতো ধরা আছে আপাত সাধারণ মজদুরদের জীবনগাথা। আচমকাই এক প্রৌঢ় কেমন বালক হয়ে যাচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়ন নেতা বাবার হাত ধরে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে কারখানায় আর মজদুর বস্তিতে। কোলে কোলে তার বড় হয়ে ওঠা। কামারহাটি বস্তিতে কত গান, আপ কোমর বন্ধ তৈয়ার হো লাখো কোটি ভাইও...।


একের পর এক গণ-আন্দোলনে তখন পশ্চিমবঙ্গ উত্তাল। খাদ্য আন্দোলন, শ্রমিক ধর্মঘট, ছাঁটাই, লে অফ, লক আউট সব মিলিয়ে অগ্নিগর্ভ বাংলা সদ্য বালক থেকে কিশোর হয়ে উঠতে থাকা মনে স্থায়ী ছাপ ফেলে দেয় কীভাবে তা সে নিজেও জানতে পারেনি। এখন এই ভেজা ভেজা সকালে ট্রেনে যেতে যেতে হারিয়ে যাওয়া শৈশব-কৈশোর তাকে অনেক কথা মনে করিয়ে দিতে থাকে। দেবতা হিসেবে বিশ্বকর্মা কত বড়, শক্তিশালী তা জানি না। তবে এটা ঠিক তিনি হচ্ছেন শিল্প দেবতা। এক অর্থে সিম্বল অফ ইন্ডাস্ট্রি। এসব লোকগাথা, লোকবিশ্বাস চর্চার বয়স তখনো হয়নি। তবে দিনটা এলেই মন ভালো হয়ে যেত। শিল্পাঞ্চল এলাকায় থাকতাম। ফলে দুর্গাপূজার ঢের আগে আমাদের কাছে উৎসব বলতে ছিল বিশ্বকর্মা পুজো। চারপাশে আলো ঝলমলে পরিবেশ। ঢাক বাজছে। মহল্লায় ঘুরে বিশ্বকর্মা দেখছি। দেখা তো অজুহাত। আসলে তো ভালোমন্দ কিছু খাবার পাওয়ার আনন্দে ঘোরা। ভালোমন্দ বলতে ওই খিচুড়ি, আলু ভাজা বা লুচি বোঁদে আর গুঁজিয়া। তাতেই মনে হতো যেন রাজ্য জয় হয়ে গেল। আর একটা বিষয়, আজকে বুঝতে পারি যে শ্রমিকদের মুখের হাসিটুকু বড় অমলিন ছিল। কোনো কোনো ফ্যাক্টরিতে বোনাস হয়ে যেত। ফলে পুজোর বাজার জমে উঠতে দেরি হতো না। সন্ধ্যাবেলায় পাড়ার এক ফ্যাক্টরিতে বাজির রোশনাই কখনো ভুলব না। আমি আর মা এক চিলতে বারান্দায় অনেক রাত অবধি দাঁড়িয়ে কত রকমের বাজি পুড়ছে দেখতাম।


কাঁকিনাড়া পার হচ্ছি। অনেক পথ চলেও এসেছি। অবাক হয়ে দেখছি, কোথাও কোনো বিশ্বকর্মা পুজোর উন্মাদনা নেই। বড় নিস্তরঙ্গ চারপাশ। ঢাকের শব্দ নেই। প্যান্ডেল সেভাবে চোখে পড়ছে না। অনেক কারখানা যেতে যেতে দেখছি বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। কোথাও কারখানার জমিতে হাইরাইজ হয়েছে। কোথাও শপিং মল। সেই মজদুর বস্তি নেই। স্টেশন চত্বরে চায়ের দোকানে গুলতানি চলছে। তবে মানুষের মুখ বড় গম্ভীর। চারপাশের ঔজ্জ্বল্য বেশ ফিকে হয়ে গেছে। বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। বিহারি শ্রমিকদের। পরশ কাকা, দশরথ কাকা, রামলাল দাদা, আনিসুর আর সেলিম চাচা। যাদের কোলে-পিঠে বড় হতে হতে এক দিন এক বালক আজাদীর গল্প শুনত। যাদের ঘামের গন্ধে মেহনতি জনতার মুক্তি লুকিয়ে ছিল। কবে কখন তারা শিখিয়েছিলেন, লাল কেল্লা পর লাল নিশান, মাঙ রাহা হায় হিন্দুস্তান... ট্রেনের বাইরে যতটুকু চোখ যায় কোথাও কোনো লাল পতাকা চোখে পড়ছে না। এক দুজায়গায় যা দু-একটা আছে, সব কেমন ফ্যাকাশে, বিবর্ণ।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us