'বাহাত্তুরে বুড়ো'র অপবাদ ঘুচল। শিল্পী শাহাবুদ্দিন আজ থেকে তিয়াত্তুরে তরুণ। বঙ্কিম চ্যাটুজ্যের অগ্রজ 'পালামৌ'খ্যাত সঞ্জীবচন্দ্র (তাঁর একটি বাক্য বহুল প্রচলিত :'বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে') আক্ষেপ করে লিখেছিলেন :'এ ক্ষণে বৃদ্ধ হইয়াছি (তখনও ৫০ পূর্ণ হয়নি)।' দেড়শ বছর আগে হয়তো ৫০ অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই লোকে বৃদ্ধ বলত। তাহলে 'বাহাত্তুরে বুড়ো' প্রবাদ এলো কোত্থেকে? নিশ্চয় বহু লোকের বয়স বাহাত্তর হতো সেকালেও, এবং বৃদ্ধ না বলে বুড়োর তকমা ঠাট্টা, পরিহাসচ্ছলে। পরিহাসে নানাবিধ সূক্ষ্ণ ব্যঙ্গ। বাহাত্তুরে বুড়ো অথর্ব, অকম্মের ধাড়ি। এর সঙ্গে ভীমরতিও যুক্ত।
একালে বাহাত্তরেও তরুণ, জোয়ান। ইউরোপিয়ানরা বলছে পঞ্চাশের পর থেকেই নাকি পোক যোবন। লোকের কথা নয়, সরকারেরও। চাকরির বয়স পঁয়ষট্টি থেকে সাতষট্টি। নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, আইসল্যান্ড সত্তর বছর পর্যন্ত করার পক্ষে। আসল হেতু ভিন্ন। জন্মহার দ্রুত কমছে। অন্যদিকে দক্ষ কর্মী পাওয়া ক্রমশ কঠিন। শ্রমিকের ঘাটতি। ইউরোপও হাড়েমজ্জায় টের পাচ্ছে। কিন্তু অভিবাসীর জন্য দ্বার উন্মুক্ত নয়। নানা ঝক্কিঝামেলা, আইনি গ্যাঁড়াকল। উপরন্তু ভাষার সমস্যা। আরও একটি। কালচারাল আইডেনটিটি। যোগ হয়েছে ধর্মও। রেসিয়াল ব্যাপারটি তো আছেই। সবার ক্ষেত্রে নয় অবশ্যই। শাহাবুদ্দিনের বেলায় প্রশ্নই ওঠে না। ফ্রান্সে ওঁকে দরকার, ইউরোপে, বিশ্বেও। শিল্পের জন্য। কালচারাল একাত্মতার প্রয়োজনে। এবং এই প্রয়োজন আন্তর্জাতিক বলয় রচনায়।
ঠিক যে, গত পঞ্চাশ বছরে বিশ্বের চেহারায় রদবদল। বিশেষত ৯ নভেম্বর ১৯৮৯-এ বার্লিন দেয়ালধস এবং ১৯৯১ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার পতন, কমিউনিজমের বেহাল, বিশ্ব ধনতন্ত্রমুখী। মানুষ ছুটছে এ-দেশে ও-দেশে। জীবিকায়। সহাবস্থানেও শামিল করছে নিজেকে, নিজেদের।
১৯৭৪ সাল থেকে প্যারিসবাসী হয়ে শাহাবুদ্দিন দেখছেন বৈশ্বিক চিত্র। তাঁর ছবির চিত্রায়ণে- রেখায়-অঙ্কনে-রঙে- মানুষের মুখাবয়বে যে ভাষ্য, যে গহন, যে দুঃখদুর্দশা, যন্ত্রণা, মানবিকতা, মানবিকতার মাধুরী প্রোজ্জ্বল। কখনও দ্রোহাত্মক, কখন তেজীয়ান। মানুষের দৈনন্দিন সংগ্রামই উপজীব্য।
মানুষই নয় কেবল; জীব গতিসম্পন্ন পশুরও।
শাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধবাদীরা শোর তুলেছেন 'একই ধারার ছবির বলয়ে ঘূর্ণমান। মাস্টারি আছে ছড়ানো ছিটানোর পরিধি ক্ষীণ।' কানে এসেছে এমন কথাও, 'তাঁকে নিয়ে বাড়াবাড়ি। ওভাররেটেড।' লক্ষণীয়, শব্দটি 'ওভাররেটেড'। কারা করছেন? দর্শক, ক্রেতা, সমালোচক? অন্যকে নিয়ে নয় কেন?
প্রশ্ন জাগে, ইতিহাস ও সমকালের প্রেক্ষাপটে নিন্দুককুল এমন দুই-দিনটি ছবি আঁকুন, যা বোধকে আলোড়িত করে? স্তব্ধতার মুহূর্ত, ঘটনার চিত্রণে মুখাপেক্ষী হই?