হিসাব করে দেখলাম, আজ থেকে ৬০ বছর আগে ঢাকা শহরে এসেছিলাম। শহর বলা ঠিক হবে না। একটা বড় গ্রাম। হাতেই গোনা যেত যানবাহনের সংখ্যা। আজকের তুলনায় রিকশার সংখ্যাও নগণ্য। পথগুলো পিচঢালা, মেঠোপথ। রাস্তার দু'ধারে গাছগাছালি অথবা ডোবা-নালা। নদীর পাশেই ছিল একটা বাজার- সদরঘাট। আর ছিল একটা বড় বাজার। পাইকারি বাজারও ছিল, সেটি চকবাজারে। কিন্তু সিনেমা হল ছিল বেশ কয়েকটি। পাশে বয়ে চলা বুড়িগঙ্গায় স্টিমার চলে। ছোট ছোট লঞ্চ আর বৈঠা টানা নৌকা। কোনো এক বিকেলে অল্প পয়সায় বুড়িগঙ্গায় ভ্রমণ করা যেত। ছিল ছোট-বড় অনেক পার্ক। শহর গড়ে উঠছে ঢিমেতালে নতুন ঢাকায়। মাটির রাস্তার ওপরে পিচ পড়েছে, কোথাও কংক্রিট। ধানমন্ডি, গুলশান গড়ে উঠেছে, দোতলা বা বড়জোর তিনতলা দালান দেখা যায়। তবে একতলা বাড়িই বেশি।
বিশ্ববিদ্যালয় পাড়াটাও বেশ নয়নাভিরাম। গাছপালা মোড়ানো ছাত্রছাত্রীদের আবাসিক হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আর শহীদ মিনার পাশাপাশি। তার সামনেই পলাশ আর শিমুলগাছের সারি। নতুন ঢাকা শহর তখন তেমন জাগেনি। ফার্মগেট সত্যিই কৃষিরই জায়গা। খামারকে কেন্দ্র করে কয়েকটি লাল ইটের অফিস। শাহবাগে হোটেল গড়ে উঠেছে, একমাত্র আধুনিক হোটেল। ক্যান্টনমেন্ট তখনও ছিল, তবে বড় কোনো দালান নেই। কিছু ব্যারাক আর তেজগাঁও এলাকার শেষে একটা এয়ারপোর্ট। এয়ারপোর্টের দালানটাই শুধু তিনতলা। প্রবল শব্দে কিছু কিছু বিমান নামে-ওঠে। বসতি গড়ে উঠেছে ঢিমেতালে। কিন্তু গাছপালা কাটা পড়ছে না।
বুড়িগঙ্গার পাড় থেকে প্রাচীন শহরটা বেশ গাছপালার মধ্য দিয়ে- বিশাল বলধা গার্ডেন (বোটানিক্যাল গার্ডেনের আদলে)- চলে এসেছে রামকৃষ্ণ মিশন হয়ে সদ্য বর্ধিষ্ণু মতিঝিলের দিকে। এখানেই ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেন, তখনকার বিখ্যাত লোকদের বাড়ি। তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব ছিল না। ভিক্টোরিয়া পার্ককে ঘিরেই কয়েকটা কলেজ, স্কুল এবং তার মধ্যেই কালেক্টরের অফিস। দুটি নাট্যমঞ্চও ছিল- একটি মাহবুব আলী ইনস্টিটিউট, অন্যটি লালকুঠি। শখের থিয়েটার হতো সেখানে। রাত্রিযাপনের জন্য কিছু বোর্ডিং। এই বোর্ডিংগুলোর মধ্যে আবার রেস্টুরেন্টও ছিল। কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডাকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল বিউটি বোর্ডিং। মোগলাই খাবারের একটা বাহার ছিল এই শহরে। কাবাব, পরোটা, শাইলু পালোয়ানের বিরিয়ানি, হালুয়া, বাকরখানি ছাড়াও নানা ধরনের মিষ্টিজাত খাবার পাওয়া যেত। লাচ্ছি আর মাঠার সরবরাহ ছিল সব জায়গায়। তখনকার সেই অনুন্নত শহরটায়ও একটা মায়াবী জনপদের স্পর্শ পাওয়া যেত।