চা-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিজনিত সমস্যা সমাধানের সংবাদ ইতিবাচক। উল্লেখ্য, সম্প্রতি দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে চা-শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করলে মালিকপক্ষ বর্তমান মজুরির সঙ্গে ১৪ টাকা যোগ করে মোট ১৩৪ টাকা করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে চা-শ্রমিকরা দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে অনড় থাকেন। দাবির পক্ষে শ্রমিকনেতাদের ভাষ্য ছিল-দীর্ঘদিন ধরে চা-শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার যেমন মজুরি, চিকিৎসা, শিক্ষা, বাসস্থানসহ বিভিন্ন দিক থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। এ অবস্থায় তারা ন্যায়সংগত দাবিতে আন্দোলন করছেন, যা অত্যন্ত যৌক্তিক। অন্যদিকে মালিকপক্ষের যুক্তি ছিল-চা-বাগানের শ্রমিকরা বর্তমানে প্রচুর সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। বাগান কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের বাসস্থান তৈরি করে দিচ্ছে; উপরন্তু প্রতিটি বাগানে চিকিৎসক, নার্স ও মিডওয়াইফের ব্যবস্থা রয়েছে। মোট কথা-রেশন, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সেবা বাগান থেকে দেওয়ায় শ্রমিকদের অবস্থা বর্তমান অবস্থা আগের মতো নাজুক নয়। তবে প্রশাসন থেকে শুরু করে চা-শ্রমিক সংগঠনের নেতারা কয়েক দফা চেষ্টা করেও শ্রমিকদের কাজে ফেরাতে পারেননি। এ পরিপ্রেক্ষিতে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেন প্রধানমন্ত্রী।
গত শনিবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেশের বৃহৎ ১৩টি চা-বাগানের মালিক বৈঠকে বসেন। বৈঠক শেষে দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা নির্ধারণ এবং তাদের সঙ্গে শিগগিরই ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আলোচনার ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শ্রমিকদের কাজে যোগদানের আহ্বান জানান। স্বস্তির বিষয় হলো, প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে শ্রমিকরা গতকালই কাজে যোগ দিয়েছেন। চা বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল, তা বলাই বাহুল্য। তিন দশক ধরে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়েছে ব্যাপকভাবে। সঠিকভাবে তদারকি করতে পারলে চা-শিল্প দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বস্তুত বাংলাদেশে চা-শিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। এক্ষেত্রে যেসব বিষয়ে ঘাটতি রয়েছে, তার যুগোপযোগী আধুনিকায়ন ও প্রত্যাশিত মানে উন্নীত করার পাশাপাশি চা-শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার ও জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে পারলে চা-শিল্প উন্নতির শিখরে স্থান করে নেবে। এক্ষেত্রে সরকারকেই ভাবতে হবে বেশি। আশার কথা, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট আন্তরিক। আমরা আশবাদী, তার সরকারের আন্তরিকতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় চা-শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নতি হওয়ার পাশাপাশি এ শিল্পেরও প্রভূত উন্নয়ন হবে।
এতদঞ্চলে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন শুরু হয়েছিল ১৮৫৪ সালে, সিলেটের মালনীছড়ায়। সেসময় চা-শিল্পকে বিকশিত করতে ব্রিটিশ সরকার ভারতের ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে দরিদ্র আদিবাসীদের ট্রেনযোগে সিলেট অঞ্চলে করে নিয়ে আসে। ভূমিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের নিয়ে আসা হলেও বাস্তবে এর প্রায় কিছুই জোটেনি বলা চলে। দেশের ১৬২টি চা-বাগানের মধ্যে ১৩৭টিই রয়েছে সিলেট বিভাগে এবং এখানে কর্মরত চা-জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৭ লাখ। স্বল্পমজুরি এবং সব ধরনের নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত থাকায় জীবনমানের সব সূচকেই পিছিয়ে রয়েছেন চা-শ্রমিকরা। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিবছর নতুন মজুরি বাস্তবায়নের কথা থাকলেও বিগত ১৯ মাসেও নতুন মজুরি নির্ধারণ হয়নি চা-শ্রমিকদের। সরকার ও বাগান কর্তৃপক্ষ শুধু আশ্বাস দিয়ে এতদিন পার করেছে। এবার প্রধানমন্ত্রী নিজে এদিকটায় মনোযোগ দেওয়ায় চা-শ্রমিকদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এক্ষেত্রে বর্ধিত মজুরির পাশাপাশি চা-শ্রমিকদের প্রাপ্য ন্যায়সংগত ও যৌক্তিক অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার ব্যাপারে মালিকপক্ষ ও সরকার আন্তরিক হবে-এটাই প্রত্যাশা।