নরসিংদীতে জিন্স পরিহিত এক তরুণীকে মারধর এবং হেনস্তা করার অভিযোগে মার্জিয়া আকতার শিলা নামের যে আসামিকে গত সপ্তাহে মহামান্য হাইকোর্ট জামিনে মুক্তির আদেশ দিয়েছিলেন, ২১ অগাস্ট আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি জনাব এনায়েতুর রহিম সেই জামিনের আদেশ নাকচ করে দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি, অসাম্প্রদায়িকতার প্রতি, ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতির প্রতি বিশ্বাসী সকলেই এ খবরে সন্তুষ্ট হয়েছেন।
জামিন দেওয়ার সময় এই মর্মে মত প্রকাশ করেছিল বলে কিছু স্বার্থান্বেষী লোক রটিয়েছিল যে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের মাননীয় জ্যেষ্ঠ বিচারপতি উল্লেখ করেছিলেন যে, “এই ধরনের পোশাক পরে গুলশান-বনানীতেও যাওয়া যায় না, সেখানে এই মহিলা কি করে নরসিংদীর মতো জায়গায় এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ পোশাক পড়ে গেলেন।” অর্থাৎ আসামি মহিলার সমালোচনা না করে মাননীয় বিচারপতি বরং আক্রান্ত মহিলার বিরুদ্ধে এবং তার পোশাকের সমালোচনা করে তার বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছিলেন বলে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।
আমি শুরুতেই বলতে চাই, এই মাননীয় বিচারপতিকে আমি গত চার দশক ধরে অতি ঘনিষ্ঠভাবে চিনি। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একজন অদম্য সৈনিক। তিনি আপসহীনভাবে অসাম্প্রদায়িক, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে কঠোর, যাকে একজন কঠিন বঙ্গবন্ধু সৈনিক বলতে আমার কোন দ্বিধা নেই। সেই অর্থে এই মাননীয় বিচারপতি এ ধরনের কথা বলে থাকতে পারেন এটা আমার পক্ষে বিশ্বাস করা বেশ কঠিন ছিল। আমার ধারণা কিছু ধর্মান্ধ মৌলবাদী লোক সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে মাননীয় বিচারপতির উক্তি বিভ্রান্তিকরভাবে প্রকাশ করেছে।
একজন বাঙালি হিসেবে আমি শাড়ি পরার পক্ষে। কেননা শাড়ি, কপালে টিপ এগুলোই হচ্ছে বাঙালি ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রীরা এবং কর্মজীবী নারীদের পক্ষে সব সময় শাড়ি পড়া সম্ভব হয় না, কেননা শাড়ি এমনি একটি পোশাক যেটি পড়ে কাজকর্ম করা কঠিন। সে কারণেই এই শ্রেণিভুক্ত নারীদের প্রায়ই শাড়ির বিকল্প পোশাক পড়তে হয়, যথা সালোয়ার কামিজ, জিন্স ইত্যাদি। আমাদের দেশের প্রচুর নারী একই কারণে সালোয়ার কামিজ পড়ে থাকেন। সালোয়ার কামিজও কিন্তু আমাদের জাতীয় পোশাক নয়, এটি এসেছে উত্তর ভারত এবং পাকিস্তান থেকে। কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদে এটিও মাঝে মাঝে পরতে হয়, যেমন পরতে হয় জিন্সের ট্রাউজার। আজ সারা বিশ্বে জিন্সের ট্রাউজার একটি কমন পোশাকে পরিণত হয়েছে। স্থান-কাল-ধর্ম-পাত্র নির্বিশেষে এবং ভৌগোলিক সীমা রেখা অতিক্রম করে জিন্সের ট্রাউজার আজ সারা বিশ্বের নারীদের সার্বজনিন পরিধেয় পোশাক হিসেবে প্রচলন পেয়েছে। বলা যেতে পারে পৃথিবীর ৭০ শতাংশ মহিলা কোন না কোন সময় ট্রাউজার, বিশেষ করে জিন্সের ট্রাউজার পরিধান করে থাকেন প্রয়োজনের তাগিদে। এতে মোটেও কোন অশালীনতা নেই, এটি আদৌ কোন অবৈধ পোশাক নয়। সেই অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছাত্রী জিন্সের ট্রাউজার এবং টপস পড়ে নরসিংদী গিয়েছিলেন, তিনি নিশ্চয়ই কোন আইন ভঙ্গ করেননি এবং তার পোশাকে (যেটি সংবাদ মাধ্যমে আমার দেখার সুযোগ হয়েছে) আদৌ কোন অশালীনতা বা আপত্তিকর কিছু ছিল না। বরং মার্জিয়া (শিলা) নামক যে আসামি তাকে মারধর করলো এবং আরো দশজনকে জড়ো করিয়ে জিন্স পরিহিত তরুণীর উপর হামলা চালালো, দৃশ্যত ধর্মান্ধ শিলা নামক সে নারী অভিযুক্ত আসামি, অভিযুক্ত অপরাধের জন্য যার বিচার হওয়াই আইনের শাসনের নির্দেশনা। আপাত দৃষ্টিতে যা মনে হচ্ছে তা হলো, এই যে শিলা নামক নারী দৃঢ়ভাবে জামাতি আদর্শে বিশ্বাসী এবং আক্রান্ত তরুণী জামাতি পোশাক পরেননি বলেই শিলা তার ক্ষোভ ঝেড়েছে দেশের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে। দেশে কোন মানুষেরই অধিকার বা ক্ষমতা নেই, কেউ তার অপছন্দের কোনও পোশাক পড়লে তাকে মারধর করার। আদালতেরও কোন ক্ষমতা নেই- কে কোন পোশাক পড়বে তা নির্ধারণের। এ ঘটনা প্রমাণ করছে, জামাতিরা নারী মহলে প্রবেশ করে কত নারীর মস্তিষ্ক ধোলাই করতে সক্ষম হয়েছে।