পরস্পর প্রযুক্ত প্রতীয়মান হলেও রাষ্ট্র এবং সরকার দুটো সম্পূর্ণ আলাদা সত্তা। সংবিধানের অধীনে বিশেষ ব্যবস্থায় ৪টি বিশেষ উপকরণ নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত হয়। এই উপাদানগুলো হচ্ছেÑ নির্দিষ্ট ভূখ-, সার্বভৌমত্ব, নির্দিষ্ট জনসংখ্যা এবং জনগণের দ্বারা নির্বাচিত বা গঠিত সরকার। এর মধ্যে সরকার হচ্ছে সবচেয়ে স্পর্র্শকাতর নিয়ামক এবং একমাত্র পরিবর্তনশীল উপকরণ। সরকার হচ্ছে একটি দেশের জনগণের সেবক, রাষ্ট্রীয় আইনকানুনের বাস্তবায়ক, রক্ষক, ব্যবস্থাপক এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের সংরক্ষক বা পাহারাদার মাত্র। সু, সৎ ও জবাবদিহিমূলক পরিচালনার দায়িত্ব ছাড়া সরকারের কোনো নিজস্ব স্বার্থ থাকে না। সাধারণভাবে যাকে সবাই সরকারি সম্পদ বলে মনে করে তা আসলে রাষ্ট্রীয় সম্পদ, যার জিম্মাদার হচ্ছে সরকার। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয় সরকারের ওপর। জনগণ যদি কোনো সরকারকে উপযুক্ত মনে না করে তা হলে সেই সরকার পরিবর্তিত হতে পারে। তবে রাষ্ট্র অপরিবর্তনীয়। রাষ্ট্রের কোনো পরিবর্তন নেই।
সরকার বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকে। সব প্রতিষ্ঠানের শিরোমনি এমন কিছু মহাপ্রতিষ্ঠান থাকে যা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত যেমনÑ সুশীল সেবক সুপারিশকারী পাবলিক সার্ভিস কমিশন, হিসাব সংরক্ষণ ও নিরীক্ষা বিধায়ক সিএন্ড এ জি, নির্বাচন অনুষ্ঠান আধিকারিক নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগের হর্তাকর্তা প্রধান বিচারপতি ইত্যাদি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে চলার কথা। এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর কোনো সরকার কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে পারেন না বরং সরকারের ওপর এসব প্রতিষ্ঠানের খবরদারি বা প্রভাব প্রাধান্য থাকাটাই সাংবিধানিক বিধান। যদি সরকার এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রভাব বিস্তার করে তা হলে তারা তাদের দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে তাতে রাষ্ট্রের চেয়ে সরকারেরই ক্ষতি বেশি। এ চার প্রতিষ্ঠান ছাড়াও আরও কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলোর ওপর সরকারের প্রভাব বিস্তারের কোনো অবকাশ নেই। যেমনÑ দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ আরও যেসব কমিশন বা বোর্ড আছে। সমাজে সুশাসন এবং দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ প্রতিষ্ঠায় এসব সংস্থাকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের আবশ্যিকতা অনস্বীকার্য। এসব নিয়ন্ত্রক সংস্থা রাষ্ট্রের পক্ষে সঠিক ভূমিকা পালনের পরিবর্তে তারা তাদের এসব সংস্থা সরকারের আজ্ঞাবাহক হয়ে পড়লে সমাজে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত হয় না। যেমনÑ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। কমিশন দেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত। একটি দেশের অর্থনীতিতে পুঁজিবাজারের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে পুঁজিবাজারের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার কথা। উন্নত দেশগুলোতে শিল্পে অর্থায়নের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ অর্থায়ন আসে পুঁজিবাজার থেকে। বাংলাদেশের বিকাশমান পুঁজিবাজার তার কাক্সিক্ষত ভূমিকা পালন পর্যায়ে উঠতে পারছে না। যদি দেখা যায় দেশের শিল্পায়ন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের পুঁজিবাজার সেভাবে দায়িত্ব বা ভূমিকা পালন করতে পারছে না। তা হলে নিয়ামক সংস্থা বিএসইসির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। ব্যক্তি পর্যায়ে যারা স্বল্প পুঁজির মালিক তারা এককভাবে শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। কিন্তু তারা ইচ্ছা করলে পুঁজিবাজারে অংশ নিয়ে নিজেদের এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অংশ নিতে পারে। তারা দেশের খ্যাতিমান শিল্প-কারখানার শেয়ারের মালিক হতে পারেন। এতে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ সুগম হওয়ার পাশাপাশি ব্যক্তিগত মর্যাদা বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। দেশের বড় বড় কোম্পানি তাদের প্রয়োজনীয় পুঁজির চাহিদা শেয়ারবাজার থেকে সংগ্রহণ করতে পারে। আর সাধারণ মানুষও সামান্য পুঁজি নিয়েই বৃহৎ একটি কোম্পানির শেয়ারের মালিক হতে পারেন। বিদেশি কোম্পানিগুলোকে বলা হয়েছে, তোমরা পুঁজিবাজারে লিস্টেড কোম্পানি হও তা হলে তোমাদের ১০ শতাংশ কর রেয়াত দেওয়া হবে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষকে এসব কোম্পানির মালিকানায় অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা। শেয়ারবাজারে লিস্টেড হতে বলার উদ্দেশ্য শুধু ব্যবসায় করা নয়। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাও এর একটি বড় উদ্দেশ্য। কাজেই একটি দেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ হচ্ছে বাজারকে ঠিকভাবে চলার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। সাধারণ মানুষ যাতে ইচ্ছা করলেই পুঁজিবাজারে অংশ নিতে পারে তা নিশ্চিত করা। যারা বাজারে আসছে তারা কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা প্রতারিত হচ্ছে কিনা, কেউ বাজার থেকে অনৈতিক সুবিধা আদায় করছে কিনা এসব দেখার দায়িত্ব সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে যেসব সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন তা করতে কমিশন বাধ্য। অর্থাৎ পুঁজিবাজারের উন্নয়ন এবং স্বচ্ছতার জন্য যেসব কাজ করা দরকার তার সবই করবে এই কমিশন। কোনো কারণে যদি এই সংস্থাটি সঠিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করতে না পারে তা হলে পুঁজিবাজারের বিকাশ বিঘিœত হবে এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে যারা কাজ করবেন তাদের নিয়োগ-পদোন্নতি যদি দক্ষতা, স্বচ্ছতা, নিয়মনিষ্ঠার এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে না হয়ে ভিন্নতর আনুগত্যের নিরিখে হয় তা হলে কমিশন নিরপেক্ষভবে তার ভূমিকা ও দায়িত্ব পালন করতে পারে না। যদি কোনো বিশেষ মহল থেকে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করা হয় তাহলে এসব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের পক্ষে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করা কঠিন হয়ে যায়। ’৯৬-এর পুঁজিবাজার ধস বা ২০১০ সালের কেলেঙ্কারির সময় অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান এর সঙ্গে জড়িত থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া অসম্ভবভাবে বিলম্বিত করা হয়ে থাকলে এবং এমনকি জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করার ক্ষেত্রেও অপারগতা-অনীহা দেখানোর ধারণা বাজারে ব্যাপ্ত হলে কমিশনের কার্যকারিতা সম্পর্কে আস্থাহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। আখেরে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের পরিবেশ। ২০১০ সালের পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারির পর উচ্চ পর্যায়ে গঠিত কমিটি দোষীদের চিহ্নিত করলেও তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত মামলা হলেও সেই মামলা দীর্ঘদিন ধরে কোর্টে ঝুলে থাকে। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন তো মামলার বাদী, প্রতিকার প্রতিবিধান প্রতিষ্ঠার স্বার্থে মামলার ব্যাপারে আন্তরিক ও কঠোর না হলে, যদি অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় কমিশনের বোধহয় তেমন কোনো তাগিদ নেই মামলা নিষ্পত্তির বিষয়ে। দীর্ঘদিন মামলা কোর্টে পেন্ডিং থাকার পর এক সময় কোর্ট থেকে বলে দেওয়া হলো অভিযুক্ত কোম্পানি ও ব্যক্তিরা নির্দোষ। এই রায়ের বিরুদ্ধে যে আপিল করতে হবে সে ব্যাপারেও কমিশনের কোনো তাগিদ লক্ষ করা না গেলে এ ব্যাপারে কমিশনের ভূমিকা গ্রহণ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি একটি বড় বিষয়। সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের দায়িত্ব রয়েছে। তাদের সেটা সঠিকভাবে পালন করা দায়িত্ব ও কর্তব্য। তারা এমন একটি ভাব দেখান যে, নানাভাবে চেষ্টা করেও কিছু করতে পারেননি। এটাও হওয়া অনুচিত হবে যে, কেউ যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেত চান তাকে উল্টো হেনস্তা করে আস্থাহীন পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ কেউ ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করতে চাইলেও নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হতে পারে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব পুঁজিবাজার ব্যবস্থাপনায় সহায়কের (ফ্যাসিলিটেটর) ভূমিকা পালন করা কারও বা কোনো কাজের প্রতিবন্ধক হিসেবে দাঁড়ানো নয়। কাজেই যিনি একটি প্রতিষ্ঠানে সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয় প্রধান হবেন তাকে সঠিক এবং নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে, থাকতে হবে। অন্যকেও সঠিকভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের দিকে দৃষ্টি দিলেও একই চিত্র প্রত্যক্ষ করা যাবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন নিয়ে প্রশ্ন উঠতে দেওয়া সমীচীন নয়। সার্বিকভাবে ব্যাংকিং সেক্টরে বিশৃঙ্খলা যাতে সৃষ্টি না হয়, ব্যাংকগুলো সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ভালোভাবে কাজ করতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কিনা তা রাষ্ট্রীয় সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক দেখবে। রেগুলেটর হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা তা ব্যাংকের বাইরে হোটেলে মিটিং করে নেওয়ার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত দেখে মনে হবে বাংলাদেশ ব্যাংক নিরপেক্ষভাবে তার সংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। ব্যাংকের একজন এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে নানাভাবে প্রার্থীকে যাচাই-বাছাই করা হয়। বাজারে এটা চাউর হয়ে আছে যে, কোনো কোনো ব্যাংকের এমডি নিয়োগ করা হয় আগের রাতে হোটেলে মিটিং করে এবং পরদিন সকালে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেই এমডি নিয়োগের অনুমোদন মিলে যায়। সত্যি হলে এরূপ একটি তাৎক্ষণিক অনুমোদন-পদক্ষেপ খারাপ নজির শুধু নয়, মূল প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে হলাহলপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, আস্থা ও নীতি-নিয়মের প্রতি দায়বদ্ধতাকে দুর্বল করে তোলে। এর ফলে সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট হয়। রাষ্ট্র্রীয় প্রতিষ্ঠানের দ্বারা সুশাসনের জন্য সহায়ক নয়।