সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এই মুহূর্তে এক জটিল পরিস্থিতি পার করছে। এর মূল কারণ চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে ফারাক তৈরি হওয়ায় সংকট বাড়ছে। বিভিন্ন পণ্যে ভর্তুকির কথা বলে সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে কৃষি, পরিবহন ও উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত খাতে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পরপরই বাজারে প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর সরকার শুধু পরিবহন ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে। যদিও সেই নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত আদায়ের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে প্রতিদিন। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর অন্যান্য পণ্যের দাম কী হারে বাড়বে, সে বিষয়ে সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের কোনো আলোচনা হয় না। ফলে ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিয়ে ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটি আগেও হয়েছে। এবারও ভোক্তারা বিক্রেতাদের কাছে জিম্মি হয়ে থাকছে। ব্যবসায়ীরা যুক্তি দিচ্ছে, বাড়তি ব্যয় সামাল দিতে গিয়ে দাম বাড়াতে হচ্ছে। তাদের যুক্তির সঙ্গে বাস্তবতার অনেক ফারাক। যেমন ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা বাড়ার অজুহাতে চালের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ডিজেলের দাম বাড়ায় সেচকাজে বাড়তি খরচ হবে, এটা সত্য। কিন্তু এর প্রভাব পড়ার কথা আগামী মৌসুমের পর। বর্তমানে চালের বাজারে শুধু পরিবহন খাতের প্রভাব পড়ার কথা। এতে সামান্য দাম বাড়ার কথা থাকলেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রতিক্রিয়ায় চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৪ থেকে ১৫ টাকা। একইভাবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে ব্রয়লার মুরগি, ডিম, মাছসহ সব ধরনের সবজি ও মুদি পণ্যের দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যবসায়ীরা।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই দুর্যোগকালে নিম্ন আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে। এ অবস্থায় এক কোটি মানুষের কাছে ফ্যামিলি কার্ডের আওতায় টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। খোলাবাজারে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সম্ভব হলে আরও বেশিসংখ্যক মানুষকে এই ফ্যামিলি কার্ডের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এরই মধ্যে অভিযোগ উঠেছে, অনেক নিম্ন আয়ের মানুষ ফ্যামিলি কার্ড পাচ্ছে না। বিপরীতে সামর্থ্যবান অনেকে, যাদের এই কার্ডের জন্য অযোগ্য বলা যেতে পারে, তারা কার্ড পেয়েছে। রাজনৈতিক সংশ্নিষ্টতা ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে কার্ড বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে।
ফ্যামিলি কার্ড বিতরণে জড়িত সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যাপারে নজরদারি বাড়ানো দরকার। সরকার পর্যালোচনা করে দেখতে পারে, কত সংখ্যক যোগ্য পরিবার এই কার্ডের বাইরে থেকে গেছে। একই সঙ্গে অযোগ্য কত সংখ্যক পরিবার এর আওতায় চলে এসেছে। তারপর অযোগ্যদের বাদ দিয়ে যোগ্য পরিবারকে অন্তর্ভুক্ত করে নিতে পারে। কার্ডধারীরা যাতে চাহিদামতো পণ্য পায়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। এর আগে আমরা দেখেছি, বারবার দিন-তারিখ নির্ধারণ করেও পণ্য সরবরাহ করতে পারেনি টিসিবি। কোথায় সংকট তা শনাক্ত করে দ্রুত সমাধান করতে হবে। আর ফ্যামিলি কার্ড বিতরণ দ্রুততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে করতে হবে।
বৈশ্বিক কারণে এই মুহূর্তে সরকারের আর্থিক টানাপোড়েন থাকলেও সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম কমিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে সেই টানাপোড়েন দরিদ্র মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া উচিত হবে না। দরকার হলে সরকারের অন্যান্য খাত থেকে অর্থ সাশ্রয় করে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের পরিসর আরও বাড়াতে হবে। তেল, চিনি, ডাল, পেঁয়াজের পাশাপাশি আরও বেশি সংখ্যক পণ্য ফ্যামিলি কার্ডের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। কারণ এই মুহূর্তে বাজারে সব পণ্যের দামই এসব মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে গেছে। মাসে একবার না দিয়ে এটা প্রয়োজনে প্রতি সপ্তাহে দেওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ কার্ডধারী সবাইকে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য নিশ্চিত করতে হবে। সরকার বিভিন্ন খাতে ব্যয় সংকোচনের কথা বললেও তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সরকারের ব্যয় সাশ্রয় নীতি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার। অর্থনৈতিক অপচয় কোনোভাবে যাতে না হয়, তা তদারক করতে হবে। তাহলে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসবে।