জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে লিখেছেন- 'খুলনার অবস্থা আমার জানা আছে। ছোটবেলা থেকে খুলনা হয়ে আমাকে যাতায়াত করতে হয়েছে। কলকাতায় পড়তাম, খুলনা হয়ে যেতে আসতে হতো।' খুলনার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নিবিড় সম্পর্কের কারণে গ্রন্থটিতে এই জনপদের কথা উঠে এসেছে বারবার।
এক বন্ধু আমাকে খুলনা নগরীর প্রাণকেন্দ্র পিকচার প্যালেসের দুটি ছবি দেখিয়েছিলেন। একটি স্বাধীনতার আগের, আরেকটি বর্তমান সময়ের। প্রথম ছবিটি সাদাকালো, পরেরটি রঙিন। পরের ছবিটি রং পরিবর্তন করে সাদাকালো করা হলে দেখা যায়, ছবি দুটির 'ব্যাকগ্রাউন্ড' একই। তার মানে, ৫০-৬০ বছরে এ স্থানটির অবকাঠামোগত কোনো পরিবর্তন হয়নি। অথচ এক সময় বিভাগীয় শহর হিসেবে খুলনার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
ইতিহাসের দিকে দেখলে- নীল চাষ ও লবণ ব্যবসার সম্প্রসারণ ও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৮১ সালে কিসমত খুলনা মৌজার খুলনা গ্রাম সংলগ্ন নয়াবাদ এলাকায় একটি থানা স্থাপন করে। ১৮৪২ সালে খুলনাকে মহকুমায় রূপান্তর করা হয়। ১৮৮২ সালে যশোর জেলার খুলনা ও বাগেরহাট, ২৪ পরগনা জেলার সাতক্ষীরা, কালীগঞ্জ ও বসন্তপুর নিয়ে খুলনা জেলা গঠিত হয়। খুলনার প্রথম জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ পান মি. ডব্লিউ ক্লে। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, বিপণিবিতান। ব্যবসা-বাণিজ্যেরও প্রসার ঘটতে থাকে। অফিস-আদালতকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে থাকে নানা ধরনের পেশাজীবী মানুষের ঘরবাড়ি। এভাবে খুলনায় নাগরিক জীবনের বিকাশ ও বিস্তৃতি ঘটে।
তৎকালীন ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর কলকাতার সঙ্গে খুলনা 'যশোর রোড' নামে একটি কাঁচা রাস্তার মাধ্যমে যুক্ত ছিল। ১৮৮০ সাল থেকেই খুলনার সঙ্গে কলকাতার স্টিমার যোগাযোগ ছিল। ১৮৮৪ সালে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ১৮৮৫ সালে খুলনা জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। খুলনা পৌরসভা গঠিত হয় ১৮৮৪ সালে। ১৫ সদস্যবিশিষ্ট কাউন্সিলরদের ভোটে প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন রেভারেন্ড গগন চন্দ্র দত্ত। এর এক শতাব্দী পর ১৯৮৪ সালে 'দি খুলনা সিটি করপোরেশন অর্ডিন্যান্স-১৯৮৪' অনুযায়ী খুলনা পৌরসভাকে সিটি করপোরেশন ঘোষণা করা হয়।
ব্রিটিশ আমলে খুলনা শহরের জনসংখ্যাও তেমন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়নি। দেশ বিভাগের পর হঠাৎ জনসংখ্যা বেড়ে যায় মোহাজিরদের আগমন এবং খুলনায় শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠার কারণে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে দৌলতপুর পাট ব্যবসার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে। ইপিআইডিসির তত্ত্বাবধানে দৌলতপুর ও আশপাশ এলাকায় ১১টি জুট মিল গড়ে ওঠে। সুন্দরবনের গেওয়া কাঠকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে ১৯৫৪ সালে খালিশপুর শিল্প এলাকায় ভৈরব নদের তীরে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল স্থাপন করা হয়। ১৯৬৬ সালে নিউজপ্রিন্ট মিলের পাশে হার্ডবোর্ড মিল ও শিরোমনিতে বাংলাদেশ কেবল শিল্প লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০২ সালে কাঁচামালের অভাব, অতিরিক্ত লবণাক্ততা ও ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার কারণে নিউজপ্রিন্ট ও হার্ডবোর্ড মিল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ২০২০ সালে ক্রমাগত লোকসানের কারণে জুট মিলগুলোও বন্ধ হয়ে যায়।
সর্বশেষ আদমশুমারি ছাড়া ১৯৯১ সাল থেকে খুলনা মহানগরীর জনসংখ্যা ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে। এর বিশেষ কারণ হলো- কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, অনিয়ন্ত্রিত সন্ত্রাস, সুপেয় পানির অভাব, লবণাক্ততা, অপরিকল্পিত ও অপর্যাপ্ত উন্নয়ন, নেতৃত্বের শূন্যতা। যদিও পদ্মা সেতু চালুর ফলে এ অঞ্চলে আবার শিল্পোন্নয়নের বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
খুলনা মহানগরীর অন্যতম সমস্যা হলো পানীয় জলপ্রাপ্তি। খুলনা ওয়াসা বিভিন্ন উৎস থেকে পানীয় জল সংগ্রহের চেষ্টা করলেও তা পর্যাপ্ত নয়। লবণাক্ততার কারণে উত্তোলন করা যাচ্ছে না ভূগর্ভস্থ পানি। কোনো কোনো টিউবওয়েল সফল হলেও অতি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। আবার আশপাশে 'সারফেস ওয়াটার'-এর কোনো উৎস নেই। খুলনা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ মধুমতী নদীর পানি দিয়ে খুলনা শহরের চাহিদা মেটানোর প্রাণান্ত চেষ্টা করছে।