বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সেদিন এবং তার আগের দিনটি কেমন ছিল? কিংবা কেমন ছিল ওই সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতা? বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বহু বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা দম্ভ ভরে বলেছিল, তারা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে। কেউ তাদের কিছু করতে পারবে না। সে রকম ব্যবস্থাই করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিলেন, তাদের পালের গোদা খোন্দকার মোশতাক ও জিয়াউর রহমান, খুনিদের দায়মুক্তি দিয়েছিলেন। রাজনীতির ইতিহাসে নেতা বা সরকার প্রধানকে হত্যার নজির থাকলেও বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডটি ছিল ব্যতিক্রমী এই কারণে যে, ১৫ আগস্ট শুধু বঙ্গবন্ধুকে নয়, তাঁর পরিবারের সদস্যদেরও হত্যা করা হয়েছিল। এমন কি ১০ বছরের শিশু রাসেলও খুনিদের বর্বরতা থেকে রেহাই পায়নি। শেখ মুজিব যদি শাসক হিসেবে ব্যর্থও হয়ে থাকেন, তিনি যদি বাকশাল করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে কাঁটা বিছিয়েও থাকেন, তাহলে অভিযোগ হবে তাঁর বিরুদ্ধে, কিন্তু তাঁর স্ত্রী, সন্তান এমনকি নবপরিণীতা পুত্রবধূদের কী অপরাধ ছিল?
না, ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে হত্যা করেছিল, এক সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে। তিনি ব্যর্থ শাসক ছিলেন না, তিনি গণতন্ত্রের পথ সংকুচিত না করে বরং শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে যাত্রা করেছিলেন। শোষিত মানুষেরাই সংখ্যাগুরু। তাদের মতামত স্বীকৃতি পাওয়াই তো প্রকৃত গণতন্ত্র। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন – পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত – শোষক আর শোষিত। তিনি তাঁর অবস্থান শোষিতের পক্ষে বলে অঙ্গীকার করেছিলেন। তাই শোষকদের যারা প্রতিনিধি তারা সম্মিলিতভাবেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা করে তা চরম নৃশংসতার সঙ্গে বাস্ববায়নও করেছিল। তারা যেমন দেশের মধ্যে ছিল, তেমনি ছিল দেশের বাইরেও।
বঙ্গবন্ধুকে ঠেকানো বা তাঁকে পরাজিত করার অনেক চেষ্টা হয়েছে। তিনি যখন নিজেকে রাজনীতির জন্য, গণমানুষের পক্ষের রাজনীতির জন্য প্রস্তুত করা শুরু করেন, তখম থেকেই তাঁর বিরোধিতাও আরম্ভ হয়। জেল জুলুম ফাঁসির মঞ্চ তৈরি থেকে কিছুই বাদ যায়নি। কিন্তু কিছুতেই তাঁকে দমানো যায়নি, তাঁকে জনবিচ্ছিন্ন করা যায়নি। ওদের বাঁধন যত শক্ত হয়েছে, তিনি ততই বাঁধন ছিন্ন করার সাহসে বলীয়ান হয়েছেন সাধারণ মানুষের সমর্থন পেয়ে। সত্তরের নির্বাচনে বিপুল জনরায় পেলেও তাঁর হাতে ক্ষমতা না দিয়ে চাপিয়ে দেওয়া হয় যুদ্ধ। সেই যুদ্ধও যখন শেখ মুজিবকে পরাজিত করা সম্ভব হলো না, তখনই হয়তো করা হয় তাঁকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার মহাপরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনার বাস্তব পরিণতি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ঘাতকদের দায়মুক্তি দিয়ে যারা ইতিহাস থেকে শেখ মুজিবের নাম ইরেজ করে দিতে চেয়েছে, তারা সফল হয়নি। মুজিব ইতিহাসের মহানায়ক হয়েই আছেন। ঘাতকেরা বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন।
কিন্তু যাদের ফাঁসি হয়েছে, যারা দণ্ডিত হয়ে পালিয়ে আছে, তারাই কি সব, নাকি পেছনে আরও নাম আছে? কারা তারা? তারা কি বিচারের আওতার বাইরে থাকবে?
এখানে এসে উত্তর খোঁজার সুবিধার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রেস সচিব, প্রবীণ সাংবাদিক তোয়াব খানের একটি লেখা নিচে হুবহু উদ্ধৃত করছি । তোয়াব খান এখনো জীবিত আছেন। এই লেখা নিয়ে কারও কোনো কৌতূহল থাকলে সরাসরি তাঁর কাছে গিয়েও জানতে পারেন। তোয়ার খান লিখেছেন :
" ১৫ আগস্টের আগের দিন অর্থাৎ ১৪ আগস্ট দিনটি ছিল ইভেন্টফুল, মানে বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছিল ওই দিন। এই ঘটনাগুলোর মধ্যে একটা জিনিস পরিষ্কার, যা আমি অনেকবার বলেছি বা লিখেছি। ১৫ আগস্ট এক দিনে ঘটেনি। এর পেছনে আরও ষড়যন্ত্র ছিল, সেটা দীর্ঘদিন ধরে চলছিল। এবং তাতে কারা কারা জড়িত আর সেটা কীভাবে হতে পারে, তা যারা জেনেছেন, বলারও চেষ্টা করেছেন।
মুশকিল হচ্ছে, দেশের মানুষের ওপর বঙ্গবন্ধুর খুব বেশি আস্থা ছিল। তিনি মনে করতেন, জাতির পিতাকে কেন কেউ হত্যা করবে? ১৪ আগস্টে ঘটনাটা হচ্ছে এ রকম, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু যাবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাতে সমাবর্তন বক্তৃতা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি এক্সটেম্পোর বক্তৃতা করব, তোমরা শুধু পয়েন্টগুলো লিখে দেবে। কার্ডে মোটা মোটা অক্ষরে লিখে দেবে, যেন আমার দেখতে সুবিধা হয়।’
সন্ধ্যায় গণভবনে এলেন মোকাম্মেল হক, তিনি তখন ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা সচিব। তারপর এলেন ম্যাক স্যার, মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, তিনি তখন শিক্ষামন্ত্রী। পরদিন কী হবে না-হবে, তার বিবরণ একটার পর একটা লেখা হচ্ছিল। এ ক্ষেত্রে আমার সঙ্গে ছিলেন মাহবুব তালুকদার। তিনি তখন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রেস সেক্রেটারি। তিনি আমার সহকারী ছিলেন। উনি বঙ্গভবনে আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করতেন। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্রপতি হলেন, তখন তিনি এখানে চলে এলেন।
যা হোক, সবাই মিলে পয়েন্টগুলো লেখা হতে লাগল।