আজকে লেখার শুরুতেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাস, স্বাধীন দেশের যাত্রা শুরুর কথা এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকালীন মৌলিক আদর্শ ও দর্শন জানতে আগ্রহী হলে সর্বত্র যে নামটি একজন পাঠক পাবেন তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা, বাংলাদেশের স্থপতি এবং হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের সংগ্রাম, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ—সব কিছুতে তিনিই ছিলেন মূল পরিকল্পনাকারী, নেতা, পরিচালক, অনুঘটক ও অনুপ্রেরণার স্থল। জীবিত মুজিবের চেয়ে শারীরিকভাবে মৃত মুজিব অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে এখনো বাংলাদেশকে রক্ষা করে চলেছেন।
বঙ্গবন্ধু একই সঙ্গে স্বাধীনতার প্রবর্তক ও প্রতিরক্ষক। শারীরিকভাবে একজন মানুষ না থাকলেও তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ, দর্শন ও কর্ম এবং সেখান থেকে ঝরনাধারার মতো প্রবাহিত চেতনা কত শক্তিশালী হতে পারে তার উজ্জ্বল উদাহরণ বঙ্গবন্ধু এবং বর্তমানের বাংলাদেশ। তথ্য-উপাত্তসহ ইতিহাসের নির্মোহ বিচার-বিশ্লেষণ যেভাবেই করা হোক না কেন, শেখ মুজিবের নাম উচ্চারিত হবে উজ্জ্বল রঙিন বর্ণচ্ছটায়। স্বাধীনতা রক্ষাসহ রাষ্ট্রের উন্নতি এবং মানুষের সব বঞ্চনা ও বৈষম্য থেকে মুক্তির একমাত্র অবলম্বন বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধ।
বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জ্ঞানতাপস জাতীয় অধ্যাপক প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাকের কিছু কথা প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে চাই। ধর্মীয় উগ্রতার বলি অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ ১৯৮৪ সালে জ্ঞানতাপসের একটি সাক্ষাৎকার নেন। সেই সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘জাতির পিতা ধারণাটি দিয়ে বোঝানো হয়ে থাকে যে একটি লোকের মধ্যেই জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে ওঠে। একটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং আরো বহু ব্যাপার সংক্ষেপে জড়ো হয় ওই একটি শব্দবন্ধে। ওয়াশিংটনকে যখন বলা হয় আমেরিকার জাতির পিতা, গান্ধীকে ভারতের, জিন্নাহকে পাকিস্তানের—তখন শুধু এটাই বোঝানো হয় যে ওই কয়েকজন মানুষ স্বাধীনতা লাভের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানও ওই অর্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। একাত্তরের পঁচিশ মার্চের পরে তিনি বাংলাদেশের এক হাজার মাইলের মধ্যেও ছিলেন না, তবু সাধারণ ও একেবারে সাধারণ নয়, এমন মানুষ তাঁর কথা ভেবেই অনুপ্রাণিত হতো। যদিও তিনি শারীরিকভাবে উপস্থিত ছিলেন না, তবু তিনিই সব কিছুর কেন্দ্রে আছেন বলে মনে করা হতো। ’ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে জ্ঞানতাপস বলেন, ‘কেউ যখন নিহত হন, তখন বুঝতে হবে তিনি কোনো না কোনো উপায়ে বিশেষ কারো বিরাগভাজন হয়েছিলেন, কারো স্বার্থ ক্ষুণ্ন করেছিলেন। লিংকন, গান্ধী বা শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে, তাঁরা একদলকে শত্রুতে পরিণত করেছিলেন। এ হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে না যে ওই ব্যক্তিরা খারাপভাবে শাসন করেছিলেন বা বহু ভুল করেছিলেন। মুজিবের সম্পর্কেও তাই। ’
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক যেমনটি বলেছেন, কাদের কাছে বঙ্গবন্ধু শত্রুতে পরিণত হন—এটাই প্রথমে দেখা যাক। প্রথমত, পাকিস্তান, বিশেষ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। দ্বিতীয়ত, বাঙালি, যাঁরা বাংলাদেশ চাননি; জামায়াত, মুসলিম লীগের তিন গ্রুপসহ সব উগ্র ইসলামপন্থী দল। তৃতীয়ত, আরেকটি পক্ষ ছিল, যারা না পশ্চিমের, না পূর্বের। এঁরা হলেন—সামরিক, বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ সার্ভিসসহ অন্যান্য সেক্টরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, যাঁরা যুদ্ধের পুরোটা সময় ঢাকাসহ সারা দেশে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগী হিসেবে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করেছেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ১৩ জন বাঙালি সচিবের একজনও মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেননি। সবার জন্যই ৯ মাসজুড়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের অবাধ সুযোগ ছিল।