রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার দায়ে ১২ সেনা কর্মকর্তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশের কথা আমরা সবাই জানি। প্রচলিত আদালত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার অভিযোগে তাঁদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন। কিন্তু হত্যাকাণ্ডটি নিছকই কয়েকজন মাঝারি পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তার কাজ ছিল না। এই হত্যাকাণ্ডের পূর্বাপর আরও বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে, বিশেষ করে রাজনৈতিক, সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের যাঁরা জেনে-শুনে-বুঝে খুনিদের হত্যাকাণ্ডটি ঘটাতে সহায়তা করেছেন, হত্যাকাণ্ডের পর তাঁদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন এবং বিচারের পথ বন্ধ করেছেন, তাঁদেরও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। বঙ্গবন্ধু হত্যার ৪৭তম বার্ষিকীতে এসেও আমরা সেই উদ্যোগটি দেখতে পাইনি।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সাক্ষ্য-প্রমাণে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালের মার্চ থেকেই প্রকাশ্য ষড়যন্ত্র শুরু হয়। খুনিরা তখন থেকেই ক্যান্টনমেন্ট, মেজর রশিদের বাসভবন, কুমিল্লার বার্ড, গাজীপুরের সালনা, খন্দকার মোশতাকের পুরান ঢাকার আগামসি লেন ও কুমিল্লার দাউদকান্দির বাড়িতে দফায় দফায় বৈঠক করেছে। খুনিরা তাদের অভিপ্রায়ের কথা সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জেনারেল জিয়াকেও অবহিত করেছিল। জিয়া তাতে নিজে জড়াবেন না বললেও ষড়যন্ত্র ঠেকানোর কোনো উদ্যোগ নেননি।
সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে যাঁরা বিদ্রোহ করেন এবং বিদ্রোহে উসকানি দেন বা উৎসাহিত করেন, তাঁরা যেমন দোষী, তেমনি যাঁরা বিদ্রোহের প্রস্তুতির খবর পেয়ে চুপ থাকেন অথবা যাঁরা বিদ্রোহ প্রত্যক্ষ করে তা দমনে সর্বশক্তি প্রয়োগে বিরত থাকেন, তাঁরাও দোষী। সেনা অভ্যন্তরে কোনো বিদ্রোহ বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনার খবর কোনো সেনাসদস্য বা কর্মকর্তা জানতে পারলে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা তাঁর কর্তব্য। সেই কর্তব্য পালনে ব্যর্থতার দায়ে তাঁকে কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি হতে হয়।
বঙ্গবন্ধু দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে সার্বক্ষণিকভাবে গোয়েন্দাদের নজরের আওতায় থাকার কথা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড শুধু এক রাতের সিদ্ধান্তে হয়নি, দীর্ঘদিন ধরে ষড়যন্ত্র চলছিল, সেই ষড়যন্ত্র আঁচ করতে না পারা এবং বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আক্রমণের সময় গোয়েন্দাদের কোনো তৎপরতা না থাকার ব্যর্থতার জন্য সেই সময়ের সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দাপ্রধান বা কর্মকর্তারাও দায় এড়াতে পারেন না। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসভবনে আক্রমণের খবর স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকে টেলিফোন করে বাহিনীপ্রধানকে জানাতে হয়েছে। এরপরও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় তাঁকেও সামরিক আদালতের বিচারের মুখোমুখি করার কথা।
যেসব ব্যাটালিয়ন বা ব্রিগেডের সৈনিক বা অফিসাররা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, সেই সব কমান্ডারকে সেনা আইনে বিচারের আওতায় আনা উচিত ছিল। সামরিক বাহিনীর মধ্যকার চেইন অব কমান্ড ভঙ্গকারীদের দমাতে ব্যর্থতার দায় তাঁদের কাঁধেও বর্তায়।