চোখের সামনে মা পুড়ছিলেন। কিন্তু কিছুই করতে পারেননি দুই মেয়ে। কারণ, তাঁরা যে কক্ষে ছিলেন, তা বাইরে থেকে তালা দেওয়া ছিল। মায়ের সেই বাঁচার আকুতি, চিৎকার এখনো কানে বাজে তাঁদের। হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয় স্থানীয় পুলিশ। একপর্যায়ে বড় বোন মা হত্যার বিচার চেয়ে নিজের রক্তে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন। এরপর নড়ে বসে পুলিশ প্রশাসন। দীর্ঘ ছয় বছর পর অপরাধী দণ্ডিত হন।
চিঠি লেখার সময় দুই বোনের বয়স তখন ১৫ ও ১১। বড় বোনটি এখন ২১ বছরের তরুণী। তাঁর নাম লতিকা বানসালি। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে লতিকা ও তাঁর ছোট বোনের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আদালত অপরাধীকে দণ্ডিত করে কারাগারে পাঠান। আর এই দণ্ডিত ব্যক্তি হলেন দুই বোনের বাবা।
লতিকার মায়ের ‘অপরাধ’ ছিল ছেলেসন্তান জন্ম দিতে না পারা। এ জন্য স্বামীর হাতে মার খাওয়া ছিল তাঁর নিত্যদিনের ঘটনা। তবে লতিকার বাবা মনোজ বানসাল অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেন, তাঁর স্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন। অবশ্য গত বুধবার উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বুলন্দশহর জেলা আদালত মনোজকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেন।
ভারতে সন্তান হিসেবে ছেলেসন্তানের আকাঙ্ক্ষা শত শত বছর ধরে সাংস্কৃতিক বিশ্বাসে মিশে আছে। তাঁরা মনে করেন, বংশের নাম বা পারিবারিক উত্তরাধিকারকে এগিয়ে নিয়ে যাবে কেবল পুরুষ। ছেলেরাই বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবার দেখাশোনা করবে। অন্যদিকে মেয়েদের বিয়েতে যৌতুক দিতে হয়, যা তাদের শ্বশুরবাড়িতে রয়ে যাবে।
অধিকারকর্মীরা মনে করেন, এই বিশ্বাসের পেছনের কারণ হলো কন্যাশিশুর প্রতি অবহেলা ও নেতিবাচক মনোভাব। এর প্রভাবে ভারতে লিঙ্গভিত্তিক জনসংখ্যার অনুপাতে ব্যাপক তারতম্য রয়েছে। মায়ের পেটে থাকার সময় সন্তান ছেলে না মেয়ে, তা চিকিৎসাব্যবস্থার মাধ্যমে জানার পর গর্ভপাতের মাধ্যমে মিলিয়ন মিলিয়ন কন্যা ভ্রূণ হত্যা করা হয়।
এই বিচারকাজ চলার সময় লতিকা ও তাঁর বোন আদালতকে জানিয়েছেন, তাঁরা কোন পরিবেশে, কীভাবে বেড়ে উঠেছেন। তাঁরা দেখেছেন, কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার দায়ে তাঁর মা অনু বানসালকে বাবা ও বাবার বাড়ির লোকজন কতটা কথা শুনিয়েছেন, কতটা নির্যাতন করেছেন। তাঁর মাকে এক এক করে ছয়বার গর্ভপাত ঘটানো হয়েছে। কারণ, সেগুলো ছিল কন্যা ভ্রূণ।
লতিকা বলেন, দিনটি ছিল ২০১৬ সালের ১৪ জুন। সেদিন সকালে চোখের সামনে তাঁদের জীবন পাল্টে যায়। দেখতে পান, তাঁদের বাবা তাঁদের মায়ের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। আর এতে সহায়তা করেছেন বাড়ির অন্য সদস্যরা।