প্রবাসে সেবারই আমার প্রথম নববর্ষ। বৈশাখ বলে বার্সেলোনায় কিছু নেই, কালবৈশাখীও সেখানে ওঠে না। তবু গায়ে চড়ালাম টকটকে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি। বহু আগে প্রিয় বান্ধবীর উপহার দেওয়া শাড়িটিই তখন আমার এক টুকরো ঢাকা, এক টুকরো মায়া। সেই শাড়ি পরে বার্সেলোনার বন্দরে হেঁটে বেড়াচ্ছি, হঠাৎ মনে হলো আজকের দিনটি বোধ হয় খানিকটা আলাদা। অন্য দিনের মতো পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে না পথচারীর দল। চোখে চোখ পড়লে মিষ্টি করে হাসছে, কাতালোনিয়ানদের সহজাত ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে বলছে, ‘তে ভেস হার্মোসা (আপনাকে সুন্দর দেখাচ্ছে)!’ কারও কারও চোখে কৌতূহলী দৃষ্টি, বিশেষ করে ইস্টারের ছুটি উপলক্ষে বন্দরে ঘুরতে আসা কিশোরীরা কৌতূহলমিশ্রিত চোখে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে।
তেমনই এক কিশোরী মেয়েকে নিয়ে এগিয়ে এলেন তার মা। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে জানালেন, তোমার পোশাকটি খুব সুন্দর, আমার মেয়ে বলেছে একদম পরির মতো! মায়ের সঙ্গে মেয়েটি তখন সলজ্জ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তখনো জানতাম না, তবে এখন জানি যে, এরপর জীবনে যতবার এই লালপাড় শাড়িটি গায়ে জড়াব, ততবার এই মা-মেয়েকে মনে পড়বে। প্রিয় শাড়ির গায়ে জড়িয়ে গেল আরও একটি প্রিয় বিকেলের স্মৃতি।
দূর প্রবাসে যাওয়ার আগে সব বাঙালি মেয়েই বোধ হয় স্যুটকেসে অন্তত একটি শাড়ি গুছিয়ে নেয়। আর সেই শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে জড়িয়ে থাকা স্মৃতিরাও তাদের সঙ্গে যাত্রা করে। এমনই এক অভিজ্ঞতার গল্প বলছিলেন উন্নয়নকর্মী মাইশা আহমেদ, ‘ইউরোপে স্নাতকোত্তর করার সময় মাল্টা ভ্রমণে বেড়িয়েছিলাম আমি আর তাসফিয়া। মাল্টার প্রাগৈতিহাসিক রাস্তায় সেবার যে শাড়িটি পরে হেঁটে বেড়িয়েছিলাম, সে শাড়ির বয়স আমার চেয়ে অনেক অনেক বেশি।’
সপুরা সিল্কের কালো-হলুদ সেই শাড়িটির মূল মালিক তাসফিয়ার নানু, উত্তরাধিকারসূত্রে তাসফিয়ার লাগেজে করে ইউরোপ চলে এসেছে। অজানা দেশের অচেনা রাস্তায় এমন স্মৃতিবিজড়িত শাড়ি গায়ে জড়িয়ে কেমন লাগছিল? প্রশ্ন করতেই মাইশার কণ্ঠে আনন্দের ফুলঝুরি, ‘আমরা ভাবি যে “আমরা” শাড়ি পরি। অথচ শাড়িও কিন্তু আমাদের পরে! সেদিন সবচেয়ে ভালোভাবে বোধ হয় এই কথাটি বুঝেছিলাম। যাকে কখনো দেখিনি, যার সঙ্গে কখনো কথা হয়নি, তার শাড়ি গায়ে জড়িয়েও যে তাঁকে অনুভব করা যায়—সেটিও আমার সেদিনেরই উপলব্ধি।’