আমাদের দেশে ১৯৯০-পরবর্তী রাজনৈতিক সব সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ব্যাপকভাবে রাজনীতিকরণ সম্পন্ন করেছে; যা দিনে দিনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাঠামোকে যেমন নড়বড়ে করে দিয়েছে, একই সঙ্গে জ্ঞানচর্চার আদর্শিক ধারাও পরিত্যক্ত হয়েছে। সব সময়ের ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাপ্রত্যাশীদের লক্ষ্য থাকে আমলাতন্ত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নিজেদের রাজনৈতিক বলয় শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করা। নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমলাতন্ত্রকে আদর্শিক দিক থেকে দুর্বল করে দেওয়াটা জরুরি মনে করেন এসব রাজনীতির কারিগর। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমলাতন্ত্রকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলার পথ তৈরি করে দেন। কারণ তারা জানেন, নৈতিক ভিত্তি দুর্বল করে দিলে তাদের দিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করা সহজ হবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পেশিশক্তি দৃঢ় করার জন্য দলীয় ছাত্ররাজনীতিসংশ্লিষ্টদের নৈতিকতার জায়গাটি ভঙ্গুর করে দেন। শিক্ষক রাজনীতির নামাবরণে জ্ঞানচর্চার জায়গাগুলোকে কীট দংশিত করে তোলেন। কিন্তু কোনো সরকারই বুঝতে চায় না, একটি দেশে শিক্ষার মান উন্নত না হলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন স্থায়ী ভিত্তি পেতে পারে না।
পাঠক, স্বাধীনতা-পূর্ব সময়কাল থেকে স্বাধীনতা-পরবর্তী বিশেষ করে গত শতকের নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত যদি লক্ষ করেন, দেখবেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরিচালনায় জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যকেই গুরুত্ব দেওয়া হতো। একটি বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞানসৃষ্টির তীর্থকেন্দ্র হবে না ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অঙ্গুলিহেলনে ভাগাড়ে পরিণত হবে, তা অনেকটা নির্ভর করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান পরিচালক উপাচার্য মহোদয়ের যোগ্যতার ওপর। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে শুরু করে পুরো পাকিস্তান আমল ও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার প্রথম দশক পর্যন্ত সরকারি রাজনৈতিক দর্শনের ব্যবস্থাপনায় পাণ্ডিত্যের বদলে রাজনৈতিক আনুগত্যের বিচারে উপাচার্য নিয়োগ হতো না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মেধায়, পাণ্ডিত্যে উজ্জ্বল শিক্ষকদের উপাচার্য হিসাবে দেখতে পেতাম। আর তাদের নিয়োগের আগে তারা কতটা প্রশাসন পরিচালনা করতে পারবেন বা প্রশাসনসংক্রান্ত কোনো দায়িত্ব পালনের পূর্ব-অভিজ্ঞতা আছে কি না এসব ছেঁদো যুক্তি তুলে দূরে সরিয়ে রাখা হতো না। একজন মেধাবী অধ্যাপক যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার যোগ্যতা রাখেন, তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে সেই ফজলুল হালিম চৌধুরী, অধ্যাপক এনামুল হক বা জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর মতো উপাচার্যদের কর্ম-ভূমিকায়। এ প্রথিতযশা অধ্যাপকরা উপাচার্য হিসাবে ব্যর্থ হননি। তখন উপাচার্যরা পাণ্ডিত্য-প্রভায় স্বনামে পরিচিত হতেন। এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োজিত উপাচার্যদের পরিচয় নানা সূত্র থেকে খুঁজে চিনে নিতে হয়।
কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ সূত্রে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় তো একধরনের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই উপাচার্য নিয়োগ হয়। সিনেটর নির্বাচিত হন শিক্ষকদের ভোটে। আর সিনেটরদের ভোটে ভিসি প্যানেল তৈরি হয়। এদের মধ্য দিয়ে ভোটের বিচারে প্রথম তিনজনের তালিকা যায় মহামান্য রাষ্ট্রপতি অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলরের কাছে। সেখান থেকে একজনকে উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় সাধারণত একই আইওয়াশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। রাজনীতিকরণের কারণে শিক্ষক রাজনীতিতে যুক্ত নানা রাজনৈতিক দলের সমর্থক রাজনৈতিক গ্রুপের শিক্ষকরা আছেন ক্যাম্পাসে। সিনেট নির্বাচন আসন্ন হলে বিভিন্ন গ্রুপ যার যার প্যানেল তৈরি করেন। সাবেক শিক্ষার্থীদের অবস্থান খুঁজে বের করেন। ভোটার হওয়ার জন্য নির্ধারিত ফি দিতে হয়। শিক্ষক গ্রুপ ফান্ড তৈরি করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব ফি দিয়ে ভোটার বানিয়ে নিজেদের পক্ষে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এরপর অনেক টাকা ছড়িয়ে ছুটতে থাকেন দেশের নানা অঞ্চলে থাকা সাবেক শিক্ষার্থী ভোটারদের কাছে। অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচনের আগে ভোটারদের ক্যাম্পাসে আনার যানবাহনের ব্যবস্থা করা এবং প্রয়োজনে আবাসনের ব্যবস্থাও শিক্ষক গ্রুপগুলো করে থাকে। তাদের বিশ্বাস, এতে প্রার্থীর গুণ বিচার না করে যে যে গ্রুপের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় তারা ক্যাম্পাসে আসতে পেরেছেন, তাদের প্যানেলে ভোট দেওয়া এ শিক্ষিত ভোটারদের ‘নৈতিক দায়িত্ব’! এভাবে নানা শিক্ষক গ্রুপ সিনেটে নিজেদের আধিপত্য নিশ্চিত করতে চান। তাদের লক্ষ্য থাকে এভাবে নিজেদের মনোনীত অধ্যাপককে ভিসি প্যানেলে বিজয়ী করা। কিন্তু এরপরও অনেক সময় শেষ রক্ষা হয় না। দৃশ্যমান ‘গণতান্ত্রিক’ প্রক্রিয়ায় সরকারগুলো নিজেদের ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য রক্ষাকবচ হাতে রাখে। সেখানে জনপ্রতিনিধি, সরকারি আমলা, কলেজের অধ্যক্ষ এমন কিছু ক্যাটাগরি থেকে কয়েকজন সিনেটর মনোনীত করে পাঠায়। তারা সাধারণত সরকার নির্দেশিত ভিসি প্রার্থী প্যানেলে ভোট দিয়ে থাকেন। এভাবে দৃশ্যমান তথাকথিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতি থাকলেও কার্যত এতে সরকারি ইচ্ছার প্রতিফলনই ঘটে। ফলে ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশভুক্ত বা অধ্যাদেশবহির্ভূত বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ হরেদরে একই হয়ে যায়। অর্থাৎ যে মহৎ উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু ’৭৩-এর অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন, তার এক ধরনের অপমৃত্যু ঘটে। এমন বাস্তবতায় মেধাবী দলনিরপেক্ষ (অন্তত আচরণে) উপাচার্য কেমন করে পাওয়া যাবে!
এ তো গেল উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া। এমন প্রক্রিয়ার পর সর্বজন পরিচিত না হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে কার্যত মুক্তচিন্তার উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা একেবারে বিরল নয়। কিন্তু উপাচার্য হিসাবে নিয়োজিত হওয়ার পর তিনি আবিষ্কার করেন তার হাত-পা বাঁধা। তার পক্ষে রাজনৈতিক সরকারের ইচ্ছার বাইরে যাওয়া কঠিন। সরকারি ছাত্র সংগঠনের নেতাদের ইচ্ছা ও আচরণকে তার মেনে নিতে হয়। যে শিক্ষক গ্রুপ নানা প্রক্রিয়ায় তাকে উপাচার্যের আসনে বসিয়েছেন, তাদের আবদার মেটাতে হয়। শিক্ষক থেকে শুরু করে কর্মচারী নিয়োগ অধিকাংশ ক্ষেত্রে করতে হয় সরকার এবং গ্রুপের সিদ্ধান্তে। এখানে মেধার মূল্যায়ন সাধারণত বড় হয়ে দাঁড়ায় না। সরকারি দল অনুসারী শিক্ষকদের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা প্রশাসনিক পদ পূরণ করা হয়। এভাবে সরকারি ছাত্র সংগঠন কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকার অনুসারী শিক্ষক এবং উপাচার্যদের ব্যবস্থাপনায় নানা আর্থিক দুর্নীতির কথাও চাউর হয়। অমন উপাচার্য কখনো কখনো ছাত্র এবং শিক্ষক আন্দোলনের মাধ্যমে অপসারিত হলে তখন তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়।
মাঝেমধ্যে সরকারপক্ষীয় বক্তব্যে ‘রাজনৈতিক বক্তব্যে’র গন্ধ পাওয়া যায়। কয়েক মাস আগে বিশেষ ইস্যুতে পেশাজীবী ইতিহাস সংগঠনের কয়েকজন কর্মকর্তা সাক্ষাৎ করেছিলাম শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম, আমরা সর্বজনমান্য পাণ্ডিত্যে উজ্জ্বল অধ্যাপকদের প্রায়ই উপাচার্য হিসাবে পাই না কেন? সজ্জন শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, তেমন অধ্যাপকদের উপাচার্যের দায়িত্ব নিতে বললেও তারা সম্মত হন না। কথাটি সঠিক; কিন্তু কেন তারা উপাচার্যের দায়িত্ব নিতে চান না, এ সত্যটি বলেননি মন্ত্রী মহোদয়। বর্তমান বাস্তবতা চালু থাকলে যে কোনো মুক্তচিন্তার অধ্যাপকের সম্মত হওয়ার কথা নয়। সরকারপক্ষ কি কথা দিতে পারবে, উপাচার্য মহোদয়কে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হবে? সরকারপক্ষের ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতির প্রভাবমুক্ত রাখা যাবে? এ বিশ্বাস সবার হয়ে গেছে যে, বর্তমান বাস্তবতায় সরকার না চাইলে মেরুদণ্ড সোজা রেখে উপাচার্য মহোদয়দের বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা কঠিন। আর সরকারগুলো নিজ নিজ ক্ষমতার অন্যতম উৎসে নিয়ন্ত্রণ হারাতে রাজি নয়। শিক্ষা কাঠামো ধ্বংস হয়ে যাক, এতে কী এসে যায়!