বাঙালির প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ-তুচ্ছতাচ্ছিল্য নতুন কোনো বিষয় নয়। প্রাচীন যুগে আজকের বিবর্তিত প্রজাতিটির উদ্ভবকালের আগেই এর বীজ বপন করা হয়। বিভিন্ন আদি কৌম নরগোষ্ঠীর মিশেলে বাঙালি যেমনি আলাদা জাতি হিসেবে তৈরি হয়েছে, ঠিক তেমনি তার ভাষাও তৈরি হয়। এই উপমহাদেশে বাঙালিবিদ্বেষের অনেক কারণ রয়েছে। কৃষ্ণবর্ণ গাত্র, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, লোকাচার বা লৌকিক ধর্ম এবং অতি অবশ্যই মুখের বুলি বা ভাষা। পূর্ব ইউরোপ থেকে আগত আর্যরা বাঙালিদের বলত ‘পক্ষীভাষী’। খাদ্যগ্রহণকে বলত অশুদ্ধচারী সর্বভূক জাতি। ধর্মাচার ছিল তাদের চোখে বৃক্ষপূজারি, ব্রত বা ব্রাত্যধর্মী অর্থাৎ ভূত-প্রেত-অপদেবতা পূজারি। ব্রাহ্মণ্য আর্য ধর্ম, বৌদ্ধ-জৈন ধর্ম, ইসলাম বা খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করলেও তাদের প্রতি ঘৃণার বদল হয়নি। আর্যাবর্ত বা উত্তর ভারতের উচ্চবর্গ দাবিদার আর্যব্রাহ্মণদের বঙ্গে পা ফেললেই ধর্মনাশ হয়ে যেত। বিধান ছিল প্রায়শ্চিত্তকরণ। ধর্মগ্রন্থ ঋকবেদে বাংলা-ভূমি এবং জনবিদ্বেষের বহু শ্লোক রয়েছে।
এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ বাঙালিরা পেয়েছিল একাত্তরের যুদ্ধে পাকিস্তানিদের কাছে। পাঞ্জাবি সৈন্যরা তো বাঙালি মুসলমানদের মুসলমানই ভাবত না। এই দৃষ্টিতে তারা বাঙালি নারীদের নির্বিচারে ধর্ষণ এবং হত্যা করেছিল। ওরা তো ইতিহাস পাঠ থেকে শিক্ষাই নেয়নি। কেননা এই উপমহাদেশে খ্রিস্টপূর্বকালে আলেকজান্ডারের গ্রিক সৈন্যরা তৎকালের তক্ষশিলা, বর্তমানের পাঞ্জাবের নারীদেরই প্রথম ধর্ষণ করেছিল। কেবল ধর্ষণ নয়, তক্ষশিলা বা পাঞ্জাবের নারীরা গর্ভবতী হয়েছিল এবং জন্ম দিয়েছিল মিশ্র জাতি-বর্ণের শিশু। বর্তমান পাঞ্জাবিরা তাদেরই বংশধর। একাত্তর সালে এই ইতিহাস যদি পাঞ্জাবি সৈন্যরা মনে রাখত, তবে বাঙালি নারীরা ধর্ষিত হতো না।