ভারত কোনো স্বর্গরাজ্য নয় বা কোনো কল্যাণমূলক আধুনিক রাষ্ট্রও নয়। অসংখ্য সীমাবদ্ধতা ও নেতিবাচকতার মধ্যেও একজন আদিবাসী সাঁওতাল নারী ভারতের রাষ্ট্রপতি হওয়ায় আমরা আনন্দিত হয়েছি। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে এবং তাঁর উঠে আসার প্রক্রিয়াকে অভিনন্দন জানাই।
অনেকে অবশ্য এটাকে শুধু বিজেপির রাজনৈতিক চাল হিসেবে দেখছেন। বলছেন দ্রৌপদী মুর্মুও তো ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানই দেবেন। বিজেপি যখন তাদের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করবে, তখন তো তিনি সেই দলের নেতা বা নেত্রীই হবেন। এখানে আলাদা কোনো হিসাব তো হবে না। কিন্তু আমি আমাদের দেশের এবং বিশ্বের আরও অনেক দেশের পরিপ্রেক্ষিত থেকে এই নিয়োগটিকে দেখতে চাইছি।
এটা বিজেপির রাজনৈতিক চাল হলেও ১২০ কোটির বেশি মানুষের দেশ ভারতে একজন আদিবাসী নারীর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। শুধু কি জনসংখ্যা? ভারতে এখনো জাত-পাত প্রথা ও বর্ণবৈষম্য প্রবল। সেখানে দলিত, হরিজন, শূদ্র, আদিবাসীসহ মুসলিমরা নিপীড়ন-নির্যাতনের মধ্যে রয়েছেন। সেই সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে এই ঘটনা বিশ্বব্যাপী আদিবাসীদের অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্নকে সামনে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।
আচ্ছা বাংলাদেশ কি একজন সাঁওতাল বা গারো, হাজং, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা বা তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো বা দলিত-হরিজনকে রাষ্ট্রপতি বানাতে পারবে? পাকিস্তান কি একজন গিলগিট বা বালুচকে প্রেসিডেন্ট বানাবে? এখনো একজন ম্রো ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলে খবর হয় আমাদের দেশে।
তৃতীয় বিশ্বে তো বটেই, নারীরা এখনো বিশ্বের অনেক দেশেই সমমর্যাদার অংশীদার নয়। আমাদের দেশের মতো ভারতেও নারীর অবস্থান প্রান্তিক। আদিবাসীদের অবস্থান আরও প্রান্তিক। সেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একজন নারীর অবস্থান আরও কতটা পেছনে, তা সহজেই অনুমেয়। দ্রৌপদী মুর্মু সেই কয়েকটি প্রান্তিকতা ডিঙিয়ে ক্ষমতায়িত হয়েছেন। তাঁকে রাষ্ট্রপতি করার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যা-ই হোক, বাস্তবতা হচ্ছে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাহীন মানুষদের একজন হয়েও বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রপতি।
ঊনবিংশ শতকে ব্রিটিশ শাসনবিরোধী সাঁওতাল বিদ্রোহের বীর শহীদ সিধু-কানু-চাঁদ-ভৈরবের উত্তরসূরি এই দ্রৌপদী মুর্মু। জাতি, ধর্ম, ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের দেশ ভারতের আছে বহুত্ববাদী উদার গণতন্ত্র। নতুন রাষ্ট্রপতি তাঁর নিজের আদিবাসী দলিত জনগোষ্ঠীসহ ধর্ম-মতনির্বিশেষে সব ভারতীয়ের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন কি না, তা সময়ই বলে দেবে।