কিছুদিন আগেও মনে করা হতো, বাংলাদেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসা একটি ব-দ্বীপ। সংকটকালে দেখছি, এর অনেকটাই ফাঁকা বুলি। মনে হচ্ছে, বিভিন্ন সময়ে নেওয়া অনেক সিদ্ধান্ত শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। এদিকে সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরের শেষদিকে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা। এ কারণে সরকারি নীতিনির্ধারকদের কথা ও কাজে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এটা মানতেই হবে, আমরা এখন একটি বৈশ্বিক সংকটের মুখোমুখি। আমাদের সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ভুক্ত দেশগুলোর অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরদের এক সভায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা ঋণ নেওয়া দেশগুলোকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ যদি বালির আকাশের মতো উজ্জ্বল হতো, তাহলে খুবই খুশি হতাম; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাস্তবতা তেমন নয়। বিশ্ব অর্থনীতির পূর্বাভাস অনেকটাই ফিকে হয়ে আসছে। অনিশ্চয়তা তুঙ্গে।’ এমন কঠিন অর্থনৈতিক বাস্তবতার ভেতরেও আমাদের রাজনীতিকরা পরস্পর পুরোনো খুনসুটির বলয়েই আবর্তিত হচ্ছেন। তাই বিষয়গুলো নিয়ে একটি গোছালো আলোচনাও প্রায় অসাধ্য হয়ে পড়েছে। তারপরও সাধ্যের ভেতরে থেকে দু-চার কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি।
১.
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আবদুর রউফ দায়িত্ব নেওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় খেলাপি ঋণ ঠেকাতে বড় ধরনের ছাড় দিয়েছেন। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফলাফল নিয়ে সংশয় আছে। আগে জেনে নেওয়া যাক আমাদের খেলাপি ঋণের সর্বশেষ চিত্রটি কী। করোনাকালে সাবেক গভর্নর ফজলে কবির ঋণ পরিশোধে যে ছাড় দিয়েছিলেন, তা এখন আর নেই। তাই নতুন করে আবার ঋণখেলাপির তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। করোনার বিপর্যয় ঠেকাতে এবং অর্থনীতির গতি ধরে রাখতে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া হয়েছিল। সেগুলোরও একটি বড় অংশ অনাদায়ি রয়ে গেছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকায়। অর্থাৎ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। এ ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ডিসেম্বরে বাড়তি খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াতে পারে। অত্যন্ত উদ্বেগের একটি চিত্র। সেই চিত্র যাতে দেখতে না হয়, সেজন্যই বাংলাদেশ ব্যাংক এতটা ছাড়ের ব্যবস্থা করেছে। আগে যে কোনো পরিমাণ মেয়াদি খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে হলে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ এককালীন অর্থ জমা দিতে হতো।
নতুন নীতিমালা অনুযায়ী আড়াই থেকে ৬ শতাংশ জমা দিলেই চলবে। আগে চলমান ও তলবি খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে ৫ থেকে ১৫ শতাংশ অর্থ জমা দিতে হতো; নতুন নিয়ম অনুযায়ী মাত্র আড়াই থেকে ৫ শতাংশ অর্থ জমা দিলে তা নিয়মিত হয়ে যাবে। পরিশোধের সময়েও সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। আগের নিয়মে খেলাপি মেয়াদি ঋণ নিয়মিত হওয়ার পর পরিশোধের সময়সীমা ছিল ৯ থেকে ২৪ মাস বা ২ বছর। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, ১০০ কোটি টাকার কম ঋণে পরিশোধের সময় ৬ বছর, ৫০০ কোটি টাকার কম ঋণে ৭ বছর এবং ৫০০ কোটি টাকার ওপরে পরিশোধের সময় পাওয়া যাবে ৮ বছর। চলমান ও তলবি ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে চলমান ও তলবি ঋণ নিয়মিত হলে পরিশোধের সময় ছিল ৬ থেকে ১৮ মাস। নতুন নীতিমালায় এ সময় ৫০ কোটি টাকার কম হলে ৫ বছর, ৩০০ কোটি টাকার কম হলে ৬ বছর, আর ৩০০ কোটি টাকার বেশি হলে ৭ বছর। পরিশোধের সুবিধা ছাড়াও খেলাপিদের আরও সুযোগ দেওয়া হয়েছে। যেমন-যেসব খেলাপি তাদের ঋণ নিয়মিত করবে, তারা পুনরায় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবে। এর জন্য সাধারণ গ্রাহককে বকেয়া ঋণের ৩ শতাংশ পরিশোধ করতে হবে। রপ্তানিকারকদের বেলায় বকেয়া ঋণের মাত্র ২ শতাংশ জমা দিলেই চলবে। আগে নতুন ঋণ নিতে হলে সাধারণ গ্রাহকদের বকেয়ার ১৫ শতাংশ এবং রপ্তানিকারকদের বকেয়ার সাড়ে ৭ শতাংশ টাকা জমা দিতে হতো।