'পথের বাপই বাপরে মনা/ পথের মা'ই মা/ এই পথের বুকেই খুঁজে পাবি/ আপন ঠিকানা।' গানটি বাজলেই চোখে ভাসে পথশিশুদের মুখচ্ছবি। নব্বই দশকে জেমস গানে গানে যেন ছুঁতে চেয়েছিলেন পথে থাকা শিশুদের কষ্টের রংগুলো। পথে জীবন কাটানো শিশুদের হাহাকার আছে এখনও। পথটাকে 'আপন ঠিকানা' মানলেও আদতে তারা ভালো নেই। নিজেদের দুরন্ত ফড়িং ভাবলেও তাদের হৃদয় আঙিনা বেদনায় ভরা, ছোট মনে কেবলই দুঃখের বসত। শিশুদের পথে নামার পেছনে আছে নতুন নতুন গল্প। কে মা, কে বাবা? কোথায় জন্ম, কোথায় ভিটে? এসব প্রশ্নের উত্তর অনেক পথশিশুরই অজানা। নিয়ন্ত্রণহীন চলাফেরায় এসব অবুঝ প্রাণ অজান্তেই দিয়েছে আঁধারে ডুব। কেউ কেউ হাঁটছে চুরি-ছিনতাই-বখাটেপনাসহ নানা অপরাধের গলিপথে। কারও হাত পেকেছে মাদক বেচাকেনায়। কেউ আবার মাদকের নেশায় বুঁদ।
রাজধানীর পথশিশুরা কেমন আছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অনুসন্ধানে নামে সমকাল। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ১০০ পথশিশুকে অনুসরণ করা হয় টানা দুই মাস (২৫ এপ্রিল থেকে ২৩ জুন)। চলে জরিপ। কমলাপুর রেলস্টেশন, গুলিস্তান, মতিঝিল, ফকিরাপুল, ভিক্টোরিয়া পার্ক, সোহরাওয়ার্র্দী পার্ক, খিলগাঁও রেলগেট, খিলগাঁও তালতলা, মালিবাগ, তেজগাঁও রেলস্টেশন, ফার্মগেট, শ্যামলী, মাজার রোড, গাবতলী এবং বিমানবন্দর রেলস্টেশনে গিয়ে এক-এক করে কথা হয় শত শিশুর সঙ্গে; যাদের সবার বয়স ১৮ বছরের নিচে। অনুসন্ধানেই উঠে আসে পথশিশুদের জীবনের বিষাদময় ছবি।
পথশিশুদের কারও মা, কারও বাবা অন্যত্র বিয়ে করে পেতেছে নতুন সংসার। আবার কারও মা-বাবা থাকলেও নেই যোগাযোগ। পারিবারিক সম্পর্কে টানাপোড়েন, মা-বাবার বিচ্ছেদ, দারিদ্র্য, অযত্ন-অবহেলা, মাদকে জড়িয়ে পড়াসহ নানা কারণেই তারা আজ বোহেমিয়ান।
২০০৪ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, সারাদেশে রয়েছে ৬ লাখ ৭৯ হাজার ৭২৮ পথশিশু। এর মধ্যে ঢাকাতেই থাকে ২ লাখ ৪৯ হাজার ২০০।
সমকাল জরিপ চালিয়ে দেখেছে, রাজধানীর রাস্তায় থাকা ৭৯ শতাংশ পথশিশুই মাদকাসক্ত। ৭০ শতাংশ পথশিশু পায় না তিনবেলা খাবার। জন্মপরিচয় জানে না এমন শিশু ৬ শতাংশ। ৫৫ শতাংশ শিশু অসুস্থ হলেও চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। বিভিন্ন সময় নানা কারণে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ৪৭ শতাংশ। রাস্তায় বাস করলেও ৬২ শতাংশ শিশু স্বপ্ন পোষে মনে। বড় হয়ে কী করবে- সেটাও ভাবে তারা। ৫৭ শতাংশ পথশিশু রাস্তাকেই মনে করে 'সুন্দর' জীবন। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে আর চায় না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায়নি ৭৬ শতাংশ শিশু। ৩৪ শতাংশ শিশু কোনো কাজই করে না, তারা পুরোপুরি নির্ভর ভিক্ষার ওপর। মাঝেমধ্যে দোকানে পানি সরবরাহ ও স্টেশনে যাত্রীদের ব্যাগ-ব্যাগেজ টানাসহ নানা কাজে লেগে আছে ৩৫ শতাংশ পথশিশু।