বাংলাদেশে ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি এবং পানিপ্রবাহের প্রাকৃতিক পথ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় সিলেট-সুনামগঞ্জসহ নিদারুণ বন্যায় তলিয়ে আছে দেশ। বন্যা পরিস্থিতির পাশাপাশি চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট ও শেরপুর-নেত্রকোনা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ঘটছে টিলা ও পাহাড়ধস। বহু মানুষ পাহাড়ধসের আতঙ্কে আছে। বিগত নির্মম টিলা ও পাহাড়ধসের ঘটনায় দেখা গেছে ঘরের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা অবস্থাতেই পাহাড়ধসে চুরমার হয়েছে জীবন। ১১ জুন ২০০৭ সালে অবিরাম বর্ষণে চট্টগ্রামের সেনানিবাস এলাকার লেবুবাগান, কুসুমবাগ, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, বান্দরবানে পাহাড়ধসে নিহত হন ১৩০-এরও বেশি পরিবেশ উদ্বাস্তু মানুষ। সে সময় লিখেছিলাম ‘পাহাড় কাটা না থামালে মৃত্যুর মিছিল থামবে না’। পনেরো বছর ধরে লিখেই চলেছি। একটির পর একটি পাহাড় বিপর্যয় হলেও এর কোনো সুরাহা হয়নি আজও। অবকাঠামো উন্নয়ন, সড়ক নির্মাণ, রিয়েল এস্টেট বাণিজ্য, করপোরেট কৃষি ও তথাকথিত উন্নয়নের নামে একটির পর একটি পাহাড় প্রশ্নহীনভাবে খুন করা হচ্ছে।
১৫ জুন ২০১০ ভোরে কক্সবাজার ও বান্দরবানে পাহাড়ধসে অর্ধশত মানুষ নিহত হন। কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার টুইন্যা পাহাড়ধসে পাঁচজন মারা যান। ২০০৮ সালের ৬ জুলাইও এখানে পাহাড়ধসে চারজন মারা যান। পাশাপাশি কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণকাজে নিয়োজিত সেনা সদস্যদেরও করুণ মৃত্যু ঘটেছে তখন। এলোপাতাড়ি পাহাড় কাটা ও পাহাড়ে প্রাকৃতিক বনের আচ্ছাদন উজাড় করার জন্যই মূলত পাহাড়গুলো ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে। টানা বৃষ্টিতে মাটি নরম হয়ে ধসে পড়ছে। দেখা গেছে, পাহাড়ের স্থায়ী বাসিন্দাদের চেয়ে যারা বাইরে থেকে পাহাড়ি এলাকায় অস্থায়ী বসবাস করছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধসে পড়ছে সেসব পাহাড়। দেখা গেছে, নদীভাঙনসহ নানান সংকটে উদ্বাস্তু হয়ে সমতল, চরাঞ্চল ও নদী অববাহিকার এসব গরিব মানুষ পাহাড়ি এলাকায় নয়াবসতি গেড়েছেন। কোনো পাহাড়ের ঢাল ৪৫ ডিগ্রির বেশি কাটা হলেই তাতে ভূমিধসের আশঙ্কা থাকে।
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, মৌলভীবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় কোথাও কোথাও পাহাড় ও টিলা কেটে ৯০ ডিগ্রি করা হয়েছে, আবার কোথাও সম্পূর্ণ মাটি কেটে সমান করে ফেলা হয়েছে। চলমান বন্যা পরিস্থিতি আমাদের এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিচ্ছে, প্রকৃতিবিরুদ্ধ উন্নয়ন সামগ্রিক জীবনযাত্রাকে ভয়াবহ হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। বন্যার পাশাপাশি পাহাড়ধস মিলে এক সংকটময় পরিস্থিতি জনজীবন ও বাস্তুতন্ত্রকে ভবিষ্যতে আরও জটিল করে তুলতে পারে। বিপর্যস্ত হবে প্রকৃতি, সমাজ, সংস্কৃতি, উৎপাদন, অর্থনীতি, জীবন ও রাজনীতি। বন্যা মোকাবিলার পাশাপাশি পাহাড় ও টিলাধস সামাল দিতে এখনই আমাদের সামগ্রিক তৎপরতা সজাগ ও সক্রিয় করা জরুরি।