শিক্ষার দর্শনই বলি, অথবা লক্ষ্যই বলি, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য বিষয়ে মৌলিক কোনো বিতর্ক নেই। আদর্শ শিক্ষা, যথার্থ শিক্ষা, প্রকৃত শিক্ষা যে নামই দিই না কেন শিক্ষার উদ্দেশ্যটা হচ্ছে, বাংলায় যেমনটা আমরা বলতে অভ্যস্ত, শিক্ষার্থীকে মানুষ করে তোলা। মানুষ অবশ্য মানুষ হয়েই জন্মায়, কিন্তু যাকে ‘মনুষ্যত্ব’ বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে সেটা পুরোপুরি জন্মগত নয়, অর্জনের ব্যাপারও। অর্জনের জন্য শিক্ষা চাই। শিক্ষার দরকার পড়ে দু’কারণে। একটা হচ্ছে, যে গুণ ও সম্ভাবনা নিয়ে মানুষের (শিশুই বলা যাক) জন্ম হয়, জন্মের পরে নানান ধরনের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রভাব সেগুলোর বিকাশকে বিঘ্নিত তো করেই, বিপদগ্রস্ত ও বিপথগামীও করতে থাকে। শিক্ষা তাই কেবল নতুন জিনিস শিক্ষাদানের ব্যাপার থাকে না, প্রাপ্ত শিক্ষাকে ভোলানোর দায়িত্বও শিক্ষাকে নিতে হয়। শিক্ষা দাঁড়ায় দুই ধরনের; একটি অনুপ্রেরণার ও পথনির্দেশের, অপরটি টেনে ধরে রাখার ও ভয় দেখানোর।
আমরা জানি মানুষের মনুষ্যত্ব থাকে তার সামাজিকতায়। মানুষ চিন্তাসক্ষম প্রাণী; মানুষ আবার দৃষ্টিশীলও নিশ্চয়ই; কিন্তু তার সৃষ্টিশীলতা, এমনকি তার বুদ্ধিমত্তাও, সামাজিকভাবেই বিকশিত হয়। আবার সমাজ মানুষকে জন্মের পর থেকেই আবদ্ধ করেও ফেলে। বলতে গেলে জন্মের পূর্ব থেকেই আবদ্ধকরণটা ঘটে। সন্তানের মা যে পরিবেশে বসবাস করেন, যে ধরনের পুষ্টি ও পরিচর্যা পান তার ওপরও সন্তানের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বেশ কিছু পরিমাণে নির্ভরশীল থাকে। এজন্যই দেখছি আলোচনাকালে আলোচকদের বক্তব্যে ‘গণ্ডি’, ‘বৃত্ত’ ইত্যাদির প্রসঙ্গ এসেছে। শিক্ষার একটা কাজ দাঁড়ায় শিক্ষার্থীকে গণ্ডি ও বৃত্তের বন্দিত্ব থেকে মুক্তিদান। অর্থাৎ কি না শিক্ষার কাজ শুধু নতুন নতুন জ্ঞান দানই নয়, অর্জিত জ্ঞান থেকে শিক্ষার্থীকে মুক্ত করাও। সমাজ যদি অসুস্থ হয় তাহলে শিক্ষার পক্ষে সুস্থ থাকাটা অসম্ভব বৈকি। আর বর্তমানে পৃথিবী জুড়েই যে সামাজিক অসুস্থতা বিদ্যমান সে-বিষয়ে তো কোনো দ্বিমত নেই। উন্নত, অনুন্নত সব সমাজেই অসুখের লক্ষণ ও প্রমাণ বিদ্যমান।