সংস্কৃতিগত অগ্রগামিতার ক্ষেত্রে ব্যাপার কিন্তু একটা আছে। সেটা হলো এই যে, সংস্কৃতির সুস্থচর্চা না থাকলে প্রদত্ত শিক্ষা যে মানেরই হোক না কেন শিক্ষার্থীদের ক্ষমতা থাকে না তা গ্রহণ করার। বস্তিতে বসবাসে বাধ্য হওয়া মানুষদেরও একটা সংস্কৃতি থাকে, কিন্তু সে-সংস্কৃতি সুস্থ নয়, এবং অবশ্যই অনাকাক্সিক্ষত। বস্তির সংস্কৃতিতে যথার্থ শিক্ষার চর্চা যে সম্ভব নয় এটাও না মেনে উপায় নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাই বস্তির সংস্কৃতি নয়, সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা চাই। শিক্ষার্থীরা ক্লাসরুমের ভেতরে, পাঠাগারে ও ল্যাবরেটরিতে যেমন শিক্ষা পাবে; তেমনি না চাইতেও শিক্ষা পেয়ে যাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিযোগিতায়, নাটকে, গানে, বিতর্কে, সাহিত্যচর্চায় এবং খেলাধুলায় অংশ নিয়ে। সংস্কৃতির এই চর্চাটা আগের দিনে যে খুব প্রচুর পরিমাণে ঘটত তা নিশ্চয়ই নয়, কিন্তু এখন তা আরও কমে গেছে। অনেক ক্ষেত্রেই ঘাটতি দেখা দিয়েছে গুণের দিক থেকেও।
শিক্ষার্থীদের জন্য সংস্কৃতিচর্চার সবচেয়ে স্বাভাবিক ও প্রশস্ত পরিসরটি হচ্ছে ছাত্র সংসদ। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একসময় ছিল দৃষ্টান্ত; এবং অনুকরণীয় আদর্শও। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সেখানে ছাত্র সংসদ ছিল। সন্ধ্যাগুলো মুখর থাকত নাট্যাভিনয়, বিতর্ক, সংগীতানুষ্ঠান, বক্তৃতা ইত্যাদিতে। সাহিত্যচর্চা চলত প্রাণবন্ত রকমের। ছাত্র সংসদের বার্ষিক নির্বাচন ছিল উৎসবের মতো। ব্রিটিশ শাসনামলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন ছিল নিয়মিতই। এমনকি পাকিস্তানি সামরিক শাসন আমলেও ছাত্র সংসদ জীবন্ত ছিল। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর পরিস্থিতি বদলে গেছে। এ আমলে ছাত্র সংসদের নির্বাচন প্রথমে স্থগিত হলো, পরে হয়ে গেল অনিয়মিত, এবং নব্বইয়ের দশকে এসে, সামরিক শাসন হটিয়ে যখন থেকে কথিত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম হলো, তখন থেকেই ছাত্র সংসদ গেল উধাও হয়ে। এরপর জাতীয় সংসদ নির্বাচন তবুও হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মচারীরাও দেখা গেছে নিজেদের সংগঠনের বার্ষিক নির্বাচন করে যাচ্ছেন। নির্বাচন নেই শুধু শিক্ষার্থীদের সংসদের, যেখানে থাকাটা ছিল সবচেয়ে স্বাভাবিক। এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক জীবনের (দুইয়ের মধ্যে কোনো বিচ্ছিন্নতা নেই) জন্য ছাত্র সংসদ অত্যন্ত জরুরি। এর অনুপস্থিতির দরুন সংস্কৃতিচর্চারও নিরুদ্দিষ্ট হওয়ার দশা।