চা বাগান নামটা শুনলেই কেমন যেন বাগান বাগান অনুভূতি তৈরি হয়। কিন্তু বাস্তবে এটা ফুলের বাগানের মতো বাগান নয়, চা উৎপাদন খামার। প্রতিটি খামারে আছে শত শত একর জুড়ে বিস্তৃত চা-গাছের সারি, চা প্রক্রিয়াজাত করার কারখানা, চা পাতা ওজন করার স্থান, একটু ছোট্ট বাজার যেখানে দরদাম করে শ্রমিকরা বিশেষ করে নারীশ্রমিকরা তরিতরকারি কেনেন, বাগানের তুলনায় পরিচ্ছন্ন এবং সুন্দর মন্দির, ছোটখাটো মদের দোকান, যার ক্রেতা প্রধানত পুরুষ শ্রমিকরা, শত শত জীর্ণশীর্ণ বাড়ির মতো মৃত্তিঙ্গা ধরনের ঘর যেখানে বংশপরম্পরায় চা শ্রমিকরা বসবাস করেন, যেখানে তাদের সঙ্গে তাদের পরিবারের সদস্যের মতো ছাগল, মুরগি এমনকি গরুও থাকে, এক চিলতে জমি যেখানে একটু সবজি বা কোনো গাছ লাগানোর চেষ্টা চলে, থাকে বিশাল বাংলো, যা ম্যানেজার, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার বাসভবন, থাকে অফিস ভবন, যন্ত্রপাতি রাখার শেড আর প্রবেশ মুখে থাকে বিশাল এক গেট। সব মিলিয়ে এক বিশাল কারবার! বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চির সবুজ চা গাছ আর ছায়াবৃক্ষ মিলে এক দারুণ স্নিগ্ধ পরিবেশ। এই স্নিগ্ধতার কারিগরদের রুক্ষ, নীরস জীবন যেন কারও চোখেই পড়ে না।
বাংলাদেশ অঞ্চলে প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান মালিনি ছড়া চা বাগান ১৮৫৪ সালে। চায়ের আদি উৎস চীনে এবং বিশ্ববাণিজ্য শুরু চীনের মাধ্যমে। কিন্তু ব্রিটিশরা চায়ে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার পর এবং এর বাণিজ্য সম্ভাবনা দেখে আসাম এবং বাংলায় চা চাষের উদ্যোগ নেয়। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি নিরসন এবং চায়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে চা চাষের উদ্দেশ্যে আসাম এবং বাংলার ব্রহ্মপুত্র এবং সুরমা উপত্যকার লাখ লাখ একর ভূমি নামমাত্র মূল্যে বন্দোবস্ত নেয় তারা। প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশ মালিকানায় শত শত চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। কৃষিভিত্তিক চা-শিল্পের জন্য প্রয়োজন প্রচুর শ্রমিক। ফলে লাখ লাখ শ্রমিক সংগ্রহ করতে ওড়িশা, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, যুক্ত প্রদেশ, মাদ্রাজ, পশ্চিমবঙ্গ ইত্যাদি বিভিন্ন অঞ্চলের দারিদ্র্যপীড়িত মানুষকে টার্গেট করে দালাল বা আড়কাঠি নিয়োগ করা হয়। প্রচুর আয়ের প্রলোভন দেখিয়ে মানুষকে বলা হলো, চলো এমন দেশে যাই যেখানে ‘গাছ হিলানেসে প্যায়সা মিলেগা’ অর্থাৎ গাছ হিলালে পয়সা মিলে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে শিকড় ছিন্ন করে লাখ লাখ মানুষ আশায় বুক বেঁধে পারি জমায় চা বাগানগুলোতে।