বাম হাতে থালা-বাটি, আর ডান হাতে এক টুকরো পুরাতন কাপড়। সেই কাপড় দিয়ে টেবিলে পরে থাকা খাবারের উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার করছে। এমন সময় ডাক এলো, `স্বাধীন, দুই নম্বর টেবিলে পানি দে।‘ থালা-বাটি রেখেই ভেতরে ছুট। মুহূর্তেই পানির গ্লাস হাতে হাজির। কিন্তু হাঁটতে ওর কষ্ট হচ্ছিল। পায়ের দিকে তাকাতেই দেখা গেল, গোড়ালি ফেঁটে রক্ত বেরুচ্ছে। সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। দৌঁড়ের ওপর কাজ করে যাচ্ছে স্বাধীন।
রাজধানীর মহাখালীর একটি হোটেলে কাজ করে সোহানুর রহমান স্বাধীন। বয়স ১০ বছর। গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে।
স্বাধীন জানায়, যেদিন থেকে বুঝতে শিখেছে, সেদিন থেকে কাজ করছে। কখনও দোকানে, কখনও টেম্পু, লেগুনায়। এখন কাজ করছে খাবার হোটেলে। কিন্তু কেউ ঠিকমত পারিশ্রমিক দেয় না, ছোট বলে ১০০-১৫০ টাকা দেয়। এ জন্য মনের কষ্টে মাঝে-মধ্যে এসব ছেড়ে বাদাম, পেয়ারা, পানি বিক্রি করে। তখন শাসানোর কেউ থাকে না, কেউ গালি দেয় না। নিজের মতো স্বাধীনভাবে করা যায়।
বাবা মারা যাওয়ার পর স্বাধীনদের পরিবারে অন্ধকার নেমে আসে। বৃদ্ধ দাদি, মা আর ছোট বোন অনামিকা জান্নাত আশাকে নিয়ে ওদের পরিবার। অভাবের সংসারে হাল ধরতে ৭ বছর বয়সেই কাজের খোঁজে ছুটতে হয়। জীবন সংগ্রামের কাছে পরাজিত হয় আনুষ্ঠানিক পাঠ।
স্বাধীন বলে, ‘কোনো কাজে ছোডগো কেউ দাম দ্যায় না। সকালে ঘুম থেইকা উডতে একটু দেরি হইলে লাত্থি মাইরা উডাইয়া দেয় মালিকের বউ। অথচ আমারে দিয়াই সব কাজ করাইয়া নেয়।’
তার অভিযোগ, মালিক বা ক্রেতা- সবাই ছোটদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে। তুই-তুকারি করে, ধমক দেয়, মা-বাবা তুলে গালি দেয়।
‘কি করমু কন, সব সহ্য কইরা নিতে হয়! আমগোর কপালডাই খারাপ, গরিব হইয়া জন্ম নিছি! কেউ আদর করে না। কিছু খাইছি কি না, শরীর ভালো কি না- কেউ জিগায় না। আমগো নিয়ে ভাববো বা কিছু হলে দেখব তো দূরে কথা?’
এই শহরে স্বাধীনের মতো হাজারও শিশু প্রতিদিন বেঁচে থাকার তাড়নায় কাজে নামছে। শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলো বলেছে, দেশে ৭৪ লাখের বেশি শিশু বিভিন্ন ধরনের শ্রমে নিয়োজিত। তাদের অনেকের বাবা নেই, কিংবা থাকলেও অসুস্থ। কারও পরিবারে রোজগারের কেউ নেই। কেউ বা বাড়তি আয়ের জন্য কাজ করছে। তবে করোনার কারণে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। করোনার সংকট কাটিয়ে উঠতে কাজে নামতে বাধ্য হয়েছে শিশুরা। এর আগে অনেকে স্কুলে পড়াশোনা করত, কিন্তু করোনায় পরিবারে চাহিদার যোগান দিতে কর্মজীবী হতে হয়েছে। মহামারির ঢেউ থামলেও তাদের আর স্কুলে যাওয়া হয় না। স্কুল থেকে ঝরে পড়ে এখন শরীরের ঘাম ঝরছে তাদের।