করোনা মহামারির ধাক্কায় বিপর্যস্ত অনেক দেশের অর্থনীতি। খাদ্যসংকটে পড়েছে কোটি কোটি মানুষ। বৈশ্বিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে জ্বালানি তেলসহ কিছু নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিতে আমাদের নাভিশ্বাস উঠেছে ঠিকই, কিন্তু ছোট অর্থনীতি ও তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে মহামারির যে ধাক্কায় আমাদের যতটা কাবু হওয়ার কথা ছিল, সেটি হতে হয়নি আমাদের। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মীরা ছিলেন আমাদের ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা। আর মহামারিকালে অর্থনীতি বাঁচানোর ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা ছিলেন কৃষক, প্রবাসী শ্রমিক ও পোশাকশ্রমিকেরা। বিশ্বজুড়ে নানা অঞ্চলে যখন দুর্ভিক্ষের দামামার ঘোষণা দিয়েছিল জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো, সেখানে এই ফ্রন্টলাইন যোদ্ধারাই আমাদের একপ্রকার বাঁচিয়ে দিয়েছেন বলতে গেলে। গত মঙ্গলবার এক ইফতার মাহফিলের বক্তব্যে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাকও বলেছেন, করোনাকালে কৃষি, প্রবাসী আয় ও তৈরি পোশাক খাত অর্থনীতিকে বাঁচিয়েছে।
কিন্তু অর্থনীতি টিকে রাখার ফ্রন্টলাইন যোদ্ধাদের সঙ্গে আমরা কী আচরণ করেছি? করোনাকালে দেশে ফেরত আসা আবার পরে প্রবাসে ফেরত যাওয়া শ্রমিকদের কোয়ারেন্টিনে থাকা, টিকা দেওয়া, ভিসা পাওয়া কিংবা টিকিট প্রাপ্তিতে প্রতিনিয়ত নাজেহাল হতে হয়েছে। হাওরে কৃষকদের অবস্থা তো গোটা দেশ এখন দেখেও না দেখার ভান করছে যেন। কাঙ্ক্ষিত বাঁধটাও তাঁরা পেলেন না ভয়াবহ অনিয়মের কারণে। ঢলের পানির নিচে তলিয়ে যাওয়া সোনালি ধান হারিয়ে কৃষকের বুক ভাসানো কান্না এখন আর কে দেখে! এরপর থাকল পোশাকশ্রমিক। মূলত এই অভাগাদের কথা বলতেই এ লেখার অবতারণা।
বিধিনিষেধে সবকিছু বন্ধ থাকলেও পোশাক কারখানাগুলোকে কোনো ছাড় দেওয়া হয়নি। একবার কারখানা বন্ধ, আরেকবার খোলো। একবার শ্রমিকদের গ্রামে পাঠিয়ে দাও, আবার বিনা নোটিশে কারখানায় হাজির হও। গাড়ি বন্ধ, ফেরি বন্ধ—রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে মাইলের পর মাইল হেঁটে আসো। মহামারিতে এমন সব লুকোচুরি খেলা হয় শ্রমিকদের জীবন নিয়ে। পোশাক কারখানার মালিকেরা সবার আগে মোটা অঙ্কের প্রণোদনা পেলেও সেসময় বেতন-ভাতার জন্য রাস্তাও অবরোধ করতে হয় শ্রমিককে, পুলিশের হামলার শিকার হতে হয়, অনেককে ছাঁটাই হতেও হয়।
এভাবেই মহামারিকালে অর্থনীতি সচল রাখার ‘প্রতিদান’ দেওয়া হলো পোশাকশ্রমিকদের। যদিও প্রতিবছর দুই ঈদের আগে বেতন-ভাতার জন্য পোশাককর্মীদের বিক্ষোভের দৃশ্য ও পুলিশের হাতে তাঁদের মার খাওয়া দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি।