নাক-মুখ ঢাকার বাড়তি কাপড় মুখোশ খুলে নিয়েছি। মুখোশ-মুক্ত হয়ে ফিরেছি উৎসবে। বৈশাখের প্রথম দিনটিতেই এর শুরু। আয়োজনে সীমারেখা টানলেও ঢাকনা দিয়ে উদযাপনের উচ্ছ্বাস আটকানো যায়নি। তবে কোভিড-১৯ বিগত চারটি ঈদ, দুই বৈশাখ এবং পূজার আনন্দকে বিষাদময় করে দিয়েছিল। স্বজনদের চলে যাওয়া, কাজ হারানো এবং আয় কমে যাওয়ার দুঃখ নিয়ে উৎসবের দিনগুলো পেরিয়ে আসতে হয়েছে আমাদের। ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক ও পারিবারিক ক্ষতির পাশাপাশি উৎসবে টাকার লেনদেন সীমিত বা প্রায় স্থবির হয়ে যাওয়ার অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ে রাষ্ট্র। প্রান্তিক ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় ব্যবসায়ী– করোনাকালে সবাই বিপর্যস্ত হয়েছে। এবার বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার সময়।
ফুটপাতে ক্রেতার ভিড়, টাকার সৌরভ। বিপণি বিতানে টাকা, কার্ডের ঘর্ষণ। ক্রেতা-বিক্রেতার চোখে-মুখে খুশির ঝরনাধারা বলছে, অর্থনীতি ফিরছে মুখোশহীন সময়ে। সত্যিই তাই। ঈদের উপহার বিনিময় ও কেনাকাটা আগের চার ঈদের চেয়ে এতটাই বেড়েছে যে, উৎপাদনকারীরা জোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। অবকাশ কেন্দ্রগুলো স্থানীয় পর্যটকদের অগ্রিম বুকিংয়ে ঠাসা প্রায়। কোভিড পূর্বকালের মতো দেশের বাইরে ঈদ উদযাপন করতে যাওয়া মানুষের ভিড় পুরনো রূপে ফিরেছে। এবার নাকি পাঁচ লাখ মানুষ ঈদ করবেন দেশের বাইরে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের দেশ ছাড়ার হাসিমুখ দেখছি।
তবে উৎসবের জন্য মুখোশ খোলার আগেই কোভিডকালে মুখোশের পতন শুরু হয়। মুখোশ ব্যবসা, কোভিড পরীক্ষাসহ স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতির সঙ্গে ছোট কর্তা-বড় কর্তাদের মুখ উন্মোচিত হতে থাকে। স্বাস্থ্যখাত ছাড়াও অন্যান্য খাতের দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসে। সাঁতার শিখতে যাওয়াসহ নানান কেনাকাটা, বিদেশ যাত্রা নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির বড় বড় ফর্দ প্রকাশ্যে এসেছে। সর্বশেষ এলো রেলের টিকিট বিক্রির দুর্নীতির খবর। অ্যাপসের মাধ্যমে যাদের কাছে টিকিট বিক্রির ইজারা দেওয়া হলো, দস্যু লুকিয়ে ছিল সেখানেই।
শুধু টিকিট বিক্রির জায়গাতেই নয়। সর্বত্র এই রোগ। ক্ষত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কোনও কোনোটি দূরারোগ্যে পৌঁছেছে। এক মহামারি সামলে না উঠতেই আরেক মহামারি এসে কড়া নাড়তে থাকে। কিংবা বুঝে ওঠার আগেই আক্রমণ করে বসে। কোভিডের টিকা গ্রহণে বুস্টারের ব্যথা শরীরে রেখেই ডায়রিয়ায় কাবু হতে হয়েছে। শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশেই ডায়রিয়া বা কলেরা ছড়িয়ে পড়েছে। ঘরে ঘরে টিকা পাঠাতে সরকার বাধ্য হচ্ছে। হঠাৎ কেন কলেরার প্রকোপ?
দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীবাসী বলে আসছিল, ওয়াসার সরবরাহ করা পানি খাওয়ার অনুপযুক্ত। পানি হারিয়েছে নিজস্ব রঙ। কোথাও হলদেটে, কোথাও কালো। গন্ধটাও নাকে-মুখে তোলার মতো নয়। গণমাধ্যমে একাধিকবার সচিত্র রিপোর্ট হয়েছে। গ্রাহকরা পানির নমুনা অধিকর্তার কাছে পাঠিয়েও পাত্তা পায়নি। শুধু ঢাকা ওয়াসা নয়, অন্যান্য বড় শহর ও পৌরসভার সরবরাহ করা পানির একই হাল। গ্রাহকদের একদিকে ওয়াসা ও পৌর বিল শোধ করতে হচ্ছে, অন্যদিকে পানি পরিশোধন বা ফুটিয়ে নেওয়ার বাড়তি গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিলের খরচ গুনতে হচ্ছে। বহু পরিবার নির্ভর হয়ে পড়েছে বোতলজাত পানির ওপর। ফলে পরিবারের আর্থিক খরচ বেড়েছে। পানি কেনার বাড়তি খরচ তো আছেই, সেই সঙ্গে বেড়েছে চিকিৎসা ব্যয় । সেই ব্যয় আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে থাকেনি। এখন রাষ্ট্রকেও এর দায় নিতে হচ্ছে। সরবরাহ করা পানীয় জলের মান ঠিক রাখতে দফতরগুলো দরদি হলে কলেরার প্রকোপে পড়তে হতো না আমাদের। একেও তো অবহেলা, অনিয়ম ও দুনীতির কুঠুরিতে তোলা যায়?