বাইবেলে বলা হয়েছে, সৃষ্টির প্রথমে ছিল ‘শব্দ’। ‘হও’ বলেই নাকি ঈশ্বর সাত দিনে জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু যে আধুনিক সমাজ বা সভ্যতা আজ দেখছি আমরা, সেটি গড়ে তুলতে মরণশীল মানুষের কমপক্ষে গত দশটি হাজার বছর লেগেছে। আর যে কথাটি বলার জন্যে এ প্রবন্ধ, সেটি হচ্ছে, আধুনিক সভ্যতা গঠনের পেছনে অপরিহার্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে ইসলাম ধর্ম।
৫০০ খ্রিস্টাব্দে রোমের পতনের পর গ্রিক-রোমান জ্ঞানচর্চা থেকে ইউরোপ বিচ্যুত হয়েছিল। অন্ধকার যুগ চলেছিল প্রায় ৭০০ বছর, ১২০০ সাল পর্যন্ত। ইউরোপে যখন অন্ধকার যুগ (ধরা যাক, ঈশ্বরের ইচ্ছায়) আরব দেশে জন্ম নিলেন এক মহামানব হজরত মুহম্মদ (স.)। তিনি ইসলামের পতাকাতলে অসভ্য আরব বেদুঈনদের একতাবদ্ধ করলেন। নবীবংশের জাতশত্রু উমাইয়া বংশ আরব উপদ্বীপ থেকে শুরু করে ইউরোপের স্পেন এবং দক্ষিণ ফ্রান্স পর্যন্ত দখল করে নিল। লুটপাট থেকে টাকা পয়সা যখন কিছু জমলো, তখন আরবেরা জ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করলো, বাগদাদ এবং আন্দালুশিয়ায়। ইউরোপীয়রা সেই জ্ঞানের সন্ধান পেয়েছিল দুই ভাবে: প্রথমত, ‘ক্রুসেড’ করতে জেরুজালেম-সিরিয়া গিয়ে এবং দ্বিতীয়ত, উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশযাত্রা করে আন্দালুশিয়ায় এসে।
এ জ্ঞানযজ্ঞে অপরিহার্য ভূমিকা রেখেছিল অনুবাদ। জ্ঞান দৈববাণী নয় যে, আকাশ থেকে টুপ করে পড়ে সোজা মাথায় গিয়ে ঢুকে মহাপুরুষের মুখ দিয়ে বের হবে। মানুষকে পূর্বপুরুষের জ্ঞানের দধির সঙ্গে তথ্যের নতুন দুধ মিশিয়ে প্রশ্ন ও বিচারের দুই মন্থনদণ্ড দিয়ে প্রাণপণ ঘেঁটে জ্ঞানের ননী সৃষ্টি করতে হয়। সমস্যা হচ্ছে, নিজের পূর্বপুরুষ মূর্খ থাকতে পারে, আবার যে জাতি আজ শিক্ষিত, কালই সে জাতি মূর্খে পরিণত হতে পারে। ‘চক্রবৎ পরিবর্ততে সুখানি চ, দুঃখানি চ।’ সব জাতি সব যুগে জ্ঞানের সৃষ্টির লায়েক থাকে না। একেক জাতি, যেমন ভারতীয়, মিশরীয়, গ্রিক, রোমান, আরব নিজ নিজ স্বর্ণযুগে জ্ঞান সৃষ্টি করেছে। নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করতে হলে, প্রথমে পূর্বে সৃষ্ট জ্ঞান অধিগত করতে হবে। নিজের মাতৃভাষায় পূর্বতন জাতির অর্জিত সব জ্ঞান অনুবাদ করে নেওয়া যেকোনও জাতির জন্য জ্ঞানচর্চায় অপরিহার্য একটি ধাপ।