বাঙালি যে বাঙালি তা প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লাগার মাস বৈশাখ। নববর্ষ উপলক্ষ করে বাঙালির বিস্তর গুণকীর্তন এ সময়ে হয়ে থাকে। গুণগুলো অবশ্যই শ্লাঘার বিষয়। বাঙালি কীর্তনে এতই উচ্ছ্বসিত থাকি যে বলেই ফেলি, ‘থ্রি চিয়ার্স ফর দ্য বেঙ্গলিজ হিপ হিপ হুররে’।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯) দিয়েই শুরু করি, দেখা যাক বাঙালি কবিরা তাদের স্বজাতিকে কী চোখে দেখেছেন :
মহারানী ভিক্টোরিয়ার চির-অনুগত এ জাতি। কতটা অনুগত?
‘‘বাঙ্গালী তোমার কেনা একথা জানে কে না?
হয়েছি চিরকেলে দাস।
করি শুভ অভিলাষ।
তুমি মা কল্পতরু আমরা সব পোষা গরু
শিখিনি শিং বাঁকানো
কেবল খাবো খোল বিচিলি ঘাষ॥ ...
আমরা ভুসি পেলেই খুশি হব
ঘুষি খেলে বাঁচব না।’’
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত একালে জন্মগ্রহণ করলে তাকে রাজাকার কবি আখ্যায়িত করার মতো সরকারি কবির অভাব ঘটত না। তবে এটাও সত্য, ঈশ^রচন্দ্র গুপ্তকেই বাংলা সাহিত্যের প্রথম স্বাধীন কবি বিবেচনা করা হয় যিনি সরকারকে কথার চাবুকে বেশ চাবকেছেন এবং কখনো কখনো ঈশ^রকেও ছাড় দেননি।
‘‘বাঙালী বাঙ্গালী যত চিরদিন অনুগত
জানি নে মন্দ আচরণ
পুজি তোমার শ্রীচরণ।’’
রাজদ্রোহ কাকে বলে স্বপ্নেও তারা জানে না। ঈশ^রের কাছে তাদের বিনীত প্রার্থনায় রয়েছে কেবলই মহারানীর জয়কামনা।
মনোমোহন বসু (১৮৩১-১৯১২) দেখলেন প্রতিবাদহীন প্রতিরোধহীন বাঙালি ‘‘পোড়া দেশে কপাল দোষে’’ কেবলই খাবি খাচ্ছে :
‘‘পেনাল কোড কথায় কথায় বেত লাগায় গায়
ঘানি টানায় গরুর মতন।
বংশ মান যার না যেমন জন্মের মতন
দাগ চড়ে যায় হয় না মোচন।...
পঙ্গপাল শে^তপুরুতে হেথায় এসে
গ্রামে দেশের সকল সার ধন;
প’ড়ে রয় যে খোসা ভুসি-ঘাঘড়া ঘাসি
তাই খেয়ে রয় মোদের জীবন।’’
হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে (১৮৩৮-১৯০৩) এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। সপ্তম এডওয়ার্ড যখন তার বাপদাদার তালুক ভারতবর্ষের বাংলায় এলেন তার খায়েশ হলো তিনি বাঙালি পরিবারের জেনানা মহলে প্রবেশ করে দেখবেন কেমন তাদের বারি। অমনি সাড়া নিলেন সরকারি উকিল জগদানন্দ মুখোপাধ্যায়। তিনি রাজপুত্তুরকে ভবানীপুরে তার বাড়িতে অন্দরমহলে নিয়ে যান। সে বাড়ির নারীরা তাদের অভিভাবকের আদেশেই হোক কি নিজের খায়েশেই হোক বেশ সংবর্ধনা দিলেন তাকে। তারিখটা ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮৭৫। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রাজপুত্রের সফরকে কবিতায় তুলে ধরলেন বাক বাকুম বাকুম করে রাজপুত্রের জন্য পেখম মেললেন বাঙালি নারী। ক্ষিপ্ত হলেন বাংলার বৃহত্তর নারীকুল।