অন্য সবার মতো একজন শিক্ষককেও কখনো চরম স্বাধীনতা দেওয়া সম্ভব নয়। তিনি যদি শিক্ষার্থীদের নাস্তিক বানানোর চেষ্টা করেন কিংবা তাদের ধর্মান্ধ জঙ্গিতে রূপান্তরিত করার মতো কাজ করতে উদ্যত হন, তাহলে তাঁকে নিশ্চয়ই সেই স্বাধীনতা দেওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু মন খুলে কথা বলার স্বাধীনতা তাঁকে দিতেই হবে। কারণ, এ মুহূর্তে বাংলাদেশের একজন শিক্ষকের জন্য এটা কেবল তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয় নয়, এটা তাঁর পেশাগত দায়িত্ব পালনের অন্যতম প্রধান পূর্বশর্ত।
২০২৩ সালে যে শিক্ষাক্রম আসছে, সেই কারিকুলাম অনুযায়ী তাঁর দায়িত্ব হচ্ছে বিচিত্র এই জীবন ও জগতের সঙ্গে তাঁর শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া; তাঁর দায়িত্ব হচ্ছে খোলামনে সবকিছু দেখে-শুনে বিচার-বিবেচনা করে শিক্ষার্থীরা যেন সেগুলোকে গ্রহণ কিংবা বর্জন করতে পারে, তাদের ভেতর সেই ক্ষমতা তৈরি করে দেওয়া। আগে যেমন ছিল, তিনি যা ভালো মনে করতেন, তা-ই শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দিতেন, এখন আর তিনি সেটা করতে পারবেন না। অর্থাৎ তাঁর দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষার্থীদের সূক্ষ্ম চিন্তনে দক্ষ করে তোলা। একজন শিক্ষক যদি নিজে মন খুলে ভাবতে-বলতে না পারেন, তাহলে তাঁর শিক্ষার্থীরাও তা পারবে না। আর তা না পারলে, শিক্ষাবিদদের মতে, কারও পক্ষেই সুক্ষ্ম চিন্তা করা সম্ভব নয়।
নতুন শিক্ষাক্রম চালু হলে শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের ভেতর এই সুক্ষ্ম চিন্তনদক্ষতার মতো আরও নানা ধরনের সফট স্কিল তৈরি করার দায়িত্ব পাবেন। যেমন তাঁদের দায়িত্ব হবে শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও সৃজনশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা; তাদের যোগাযোগদক্ষতা বাড়ানো এবং তারা যেন পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে, তাদের মধ্যে সেই ক্ষমতা তৈরি করে দেওয়া। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের আত্মনিয়ন্ত্রণ শেখাবেন এবং একই সঙ্গে তারা যেন অন্যের মন বুঝতে কিংবা অন্যের সঙ্গে সহযোগিতা করতে পারে, তাদের মধ্যে সেই সক্ষমতা ও মনোভাবও তৈরি করে দেবেন।
এখানে লক্ষণীয়, এ রকম যত সফট স্কিল আছে, সেগুলো আয়ত্ত করার একটা সাধারণ পূর্বশর্ত হচ্ছে সবকিছু সম্পর্কে খোলামন নিয়ে ভাবার ক্ষমতা থাকা। যেমন পৃথিবীবিখ্যাত শিক্ষাবিদ কেন রবিনসন বলেন, সৃজনশীল হতে হলে একজন শিক্ষার্থীর প্রথম কাজ হচ্ছে খোলামনে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সম্ভাব্য সব রকম দিকে কল্পনা করতে শেখা। আবদ্ধ মন নিয়েও কল্পনা করা যায়, কিন্তু সেই কল্পনা মানুষকে সৃজনশীল করে তোলে না। কেন রবিনসনের বহু আগে ইংরেজ কবি টি এস এলিয়ট তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘ট্র্যাডিশনাল অ্যান্ড ইনডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট’-এ লিখেছেন, যে কবি তাঁর মনের জানালা যত বেশি খোলা রাখতে পারেন এবং নিজের ব্যক্তিত্বকে আগলে রেখে কেবল ক্যাটালিস্টের ভূমিকায় থেকে, তাঁর অনুভূতি ও আবেগগুলোকে পরস্পরের মধ্যে তিনি যত বেশি স্বাধীনভাবে ক্রিয়া-বিক্রিয়া করার সুযোগ করে দিতে পারেন, তিনি তত বড় এবং তত সৃজনশীল কবি।