ঘটনাটি সবার জানা- গত ২ এপ্রিল কলেজ শিক্ষিকা লতা সমদ্দার এক পুলিশ সদস্যের হেনেস্তার শিকার হন। ওই কনস্টেবল লতার কপালের টিপ নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন। পুলিশি তদন্তেও এর প্রমাণ মিলেছে। এই গর্হিত অপরাধের জন্য অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। চূড়ান্তভাবে বরখাস্ত হবে বলে প্রত্যাশা করি। একই সঙ্গে বিশ্বাস করি, অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের শাস্তি হলেই যে নারীর কপালের টিপ, গায়ের পোশাক ও চলন-বলন নিয়ে কটূক্তি বন্ধ হবে; তা নয়।
নারীর প্রতি বিদ্বেষ এক শ্রেণির লোকের মগজের মধ্যে রয়েছে। এসব লোক নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। তারা নারীকে গৃহে বন্দি রাখতে চায়; সেবাদাসী হিসেবে দেখতে চায়। তারা চায় না, নারীরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হোক; চাকরি-বাকরি করুক; পুরুষের সমকক্ষ হয়ে উঠুক। নারীর স্বাধীন পদচারণায় তাদের গাত্রদাহ হয়। তাই কখনও নারীর পোশাক নিয়ে, কখনও কপালের টিপ নিয়ে কটূক্তি করে। কোনো কোনো ওয়াজ মাহফিলে নারীবিদ্বেষ উস্কে দেওয়া হয়। ফেসবুক-ইউটিউবে এর প্রতিধ্বনি শুনছি।
নারীবিদ্বেষীদের পাকিস্তান আমলেও দেখেছি, এখনও দেখছি। সংখ্যায় বেড়েছে, না কমেছে; বলা কঠিন। তবে পাকিস্তান আমলে নারী আন্দোলন জোরদার ছিল। ব্রিটিশ ভারতে বেগম রোকেয়া নারী স্বাধীনতার যে সংগ্রামের সূচনা করেছিলেন; পাকিস্তান আমলেও তা অব্যাহত ছিল। দেশে তখন বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছিল। বাংলার নারীরা কপালে টিপ এঁটে শাড়ি পরে বাঙালিয়ানাকে সমুন্নত রাখতেন। সেই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানকারী নারীদের মুখে শুনেছি; পাকিস্তানিদের থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় তুলে ধরতে তারা শাড়ি পরে কপালে বড় আকৃতির টিপ লাগিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতেন।
এটি সত্য যে, স্বাধীনতাউত্তর নারীরা ব্যাপকভাবে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। নানা ক্ষেত্রে নারী অগ্রগামী হয়েছে। সমানতালে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনও বেড়েছে। কূপমণ্ডূকতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, সাম্প্রদায়িকতা, পুরুষতান্ত্রিকতাও বেড়েছে। এ সবকিছুই এখন একাকার। এ জন্য অপরিকল্পিত, ত্রুটিপূর্ণ, বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থা যে বহুলাংশে দায়ী- তা নিয়ে সংশয় নেই। এই শিক্ষা কেরানি ও কারিগর তৈরি করছে; মানুষ গড়ছে না। বরং মানুষে মানুষে, নারী-পুরুষের মধ্যে বিভাজনের দেয়াল তুলছে।
পাকিস্তান আমলে মাদ্রাসা শিক্ষা ছিল, তবে এত ব্যাপক ছিল না। সেখানে শুধু ছেলেরাই পড়ত; এখন মেয়েদেরও মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতে হচ্ছে। এর ফলে নারীদের একাংশের আধুনিক ধ্যান-ধারণার সঙ্গে পরিচয় ঘটছে না। ওইসব প্রতিষ্ঠান থেকে মেয়েদের শেখানো হচ্ছে না- তারাও সমমর্যাদার নাগরিক। ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষার কারণেই নারীমুক্তির দাবিতে সব নারী সোচ্চার হবে না। হচ্ছেও না। এমনকি, সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক নারী নিজেদের সমঅধিকারের দাবিকে সমর্থন করছে না। সামাজিক মাধ্যমে দেখি, অনেক উচ্চশিক্ষিত নারীও নারীবিদ্বেষীদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলাচ্ছেন। অতীতে নারীবিদ্বেষী কার্যকলাপ রুখে দিতে যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল; তাতেও এখন যেন ভাটার টান। আমাদের মনে রাখতে হবে, নারীর একক প্রচেষ্টায় নারী-শিশুবান্ধব সমাজ গড়ে উঠবে না। নারী অধিকার, মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে; সমতাভিত্তিক সমাজ গড়তে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার পাশাপাশি নারী-পুরুষের সম্মিলিত সামাজিক-সাংস্টৃ্কতিক আন্দোলনের বিকল্প নেই।