সমাজে মাঝেমধ্যেই কিছু গুরুতর ইস্যু আলোচনায় চলে আসে। একেবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই যে এসব বিষয় সব সময় সামনে আসে তা নয়; মাঝেমধ্যে ঘটনাক্রমে এবং দৈবক্রমেও চলে আসে। আর আমরা বিদ্যমান সামাজিক চৈতন্য থেকেই এ ধরনের বিষয় নিয়ে এক ধরনের ক্রিয়া কিংবা প্রতিক্রিয়া করি যাতে করে এসব সেনসেশনাল ইস্যু নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভাব, সমাজ মনস্তত্ত্ব ও অচেতন মনে লুকিয়ে থাকা অপ্রকাশিত অনেক কিছু প্রকাশিত হয়। এ রকমই একটি ইস্যু সম্প্রতি বাংলাদেশের জনপরিসরে বেশ আলোচনায় এসেছে। তেজগাঁও কলেজের শিক্ষক লতা সমাদ্দারের ‘টিপ’ পরা নিয়ে একজন পুলিশ কনস্টেবলের আপত্তিকর মন্তব্যকে কেন্দ্র করে জনপরিসরে টিপ সম্পর্কিত আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভঙ্গি, সামাজিক মনস্তত্ত্ব এবং সমাজের বিদ্যমান ‘পেট্রিয়ার্কির’ একটা কালো চেহারা এর মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। তাই টিপ এখন শুধু একটা ললাট সাজানোর আলংকারিক অনুষঙ্গ নয়, টিপ এখন আমাদের বিদ্যমান সমাজের আয়নায় পরিণত হয়েছে। যে টিপের ভেতর দিয়ে আমরা এখন সমাজের অনেকের চেহারা চিনতে পারছি এবং নিজেদের চেহারাও খানিকটা দেখার সুযোগ পেয়ে গেছি।
মানুষ কবে থেকে প্রথম টিপের ব্যবহার করতে শুরু করে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো দিন-তারিখ গবেষণালব্ধ তথ্য না-থাকলেও, প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে নারীর সৌন্দর্যের বর্ণনায় টিপের উপমা-উৎপ্রেক্ষার নজির আছে। তাতে সহজেই অনুমেয় যে, টিপ বঙ্গ ললনার ললাট সাজানোতে ব্যবহৃত হয়েছে প্রাচীনকাল থেকে। মানুষের মধ্যে যখন থেকে নিজেকে নান্দনিক ও শিল্পিতভাবে উপস্থাপনার রীতি চালু হয়, ধারণা করা হয়, তখন থেকেই চোখে কাজল রেখার পাশাপাশি কপালে টিপ ব্যবহারের রীতি চালু হয়েছে। তবে, ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে প্রাচীনকালে টিপের ব্যবহার ছিল কি না তা নিয়ে কোনো অথেনটিক তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু আফ্রিকার নানান আদিবাসী এবং আমেরিকার বিভিন্ন ইন্ডিয়ানসদের মধ্যে নারী-পুরুষ উভয়েরই কপালে টিপ পরার রীতি প্রচলন ছিল এবং এখনো আছে। বেদ, মহাভারত ও রামায়ণেও নারী-পুরুষ উভয়েরই টিপ পরিধানের উল্লেখ আছে। এমনকি শাহি আমল, সুলতানি আমল এবং মুঘল আমলেও অনেক নারী-পুরুষ উভয়েরই কপালে টিপ ব্যবহারের নজির আছে। বিশেষ করে, যুদ্ধে যাওয়ার প্রাক্কালে কপাল ভাগ্য টিকা আকারে টিপ ব্যবহারের নজির পাওয়া যায় ইতিহাসের পরতে পরতে। কোনো কোনো অসমর্থিত সূত্র মতে, ভারতীয় উপমহাদেশে টিপের ব্যবহার প্রায় পাঁচ হাজার বছরের। তবে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে টিপের ব্যবহারের সঙ্গে ‘হিন্দুয়ানি’ একটা লেবেল জুড়ে যায়, যা ছিল মূলত ব্রিটিশদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসির অংশ। হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে নানান দ্বন্দ্ব তৈরি করে ব্রিটিশ শাসন জারি রাখার নানা পলিসির অংশ হিসেবে টিপের ব্যবহারের সঙ্গে হিন্দু ধর্মীয় একটা সেনসিটিভিটি যুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, ঐতিহ্য এবং জীবনাচারের ধর্মনিরপেক্ষ রীতিনীতির পরম্পরায় ১৯৭১ সালের পরও স্বাধীন বাংলাদেশের শহুরে নাগরিক মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের মধ্যে টিপের প্রচলন প্রবলভাবে লক্ষ করা যায়। তারই ধারাবাহিকতায় বাঙালি নারীদের রুচিশীল সাজসজ্জা ও প্রসাধনসমাগ্রীর অনিবার্য অংশ হয়ে উঠে টিপ।