স্বাধীনতার পরে নেতারা বিধ্বস্ত অর্থনীতি গঠনে নিয়োজিত হলেন। শহরের মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি সুযোগ সুবিধা, ব্যবসা বাণিজ্য, বিহারীদের ফেলে যাওয়া প্রতিষ্ঠান ও বাড়ি এসব নিয়ে বেশিভাগই ব্যস্ত হলেন। শুধু গ্রামের কৃষক যারা লুঙ্গি কাছা দিয়ে প্রাণটারে গামছা দিয়ে বেঁধে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন, তারাই ফিরে এসে নিজের ক্ষেতে বা অপরের ক্ষেতে, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি..., আমারও দেশের, মাটির গন্ধে..., সোনা নয় যত খাঁটি তার চেয়ে খাঁটি আমার বাংলাদেশের মাটি... এসব গান কণ্ঠে নিয়ে লাঙল ধরেছিল। শুধুমাত্র গ্রামের এই উন্মুক্ত প্রান্তরে কৃষকের গলা ছেড়ে দেওয়া গানে একটি জাতির জাতি গঠনের কাজ কতটুকুই বা এগোতে পারে? এমনকি গ্রামের কৃষক যখন গলা ছেড়ে এ গান গাচ্ছে আধাপেটা খেয়ে -সে সময়ে রাষ্ট্রীয় অর্থে রাষ্ট্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এবং এখন যা উল্লেখ করে আমরা গর্ব বোধ করি বা ভোটের সময়ে বলি, আমাদের কেন ভোট দিবেন না, ধর্মের জন্যে কি আমরা এই কাজ করেনি?
অথচ একই রাষ্ট্রে কী বৈপরীত্য, একদিকে যখন রাষ্ট্রের টাকায় ধর্মীয় উন্নয়ন, চর্চা ও বিকাশের প্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছে, সে সময়ে যে সংবিধান তৈরি হচ্ছে, ওই সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি, জাতীয়তাবাদ। সঙ্গে সেক্যুলারিজম। সংবিধানের বাংলা অনুবাদকারী শ্রদ্ধেয় ড. আনিসুজ্জামানের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে বলা যায়, সেক্যুলারিজমের বাংলা ‘ইহজাগতিকতা’ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নয়। রাষ্ট্র আধুনিক কনসেপ্ট, রাষ্ট্র সবসময়ই আধুনিক হবে। রাষ্ট্র ধর্ম নির্ভর হলে, একটি পশ্চাৎপদ অতীতের দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত না হোক ওই দর্শন যদি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িয়ে যায় তাহলেও তখন আর সেটা আধুনিক রাষ্ট্র থাকে না।
বাঙালি ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছিল একটি আধুনিক রাষ্ট্র গড়ার জন্যে। যে চারটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে বাঙালি যুদ্ধ করেছিল, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ইহজাগতিকতা ও সমাজতন্ত্র চারটিই আধুনিক মতবাদ। এর ভেতর বাঙালির সব থেকে বড় ও উজ্জ্বল ছিল ‘জাতীয়তাবাদ’। কারণ, বাঙালির এই জাতিরাষ্ট্র তৈরির আগে যদিও তার কোনো কাঠামো লিখিতভাবে জাতিকে জানানোর সুযোগ পায়নি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের আগে। কিন্তু মিছিলে, স্লোগানে অতি স্বল্প অক্ষরে তা স্পষ্ট হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। সেদিনের তিনটি স্লোগান উল্লেখ করলেই বাঙালির জাতি রাষ্ট্রের সকল চরিত্র স্পষ্ট খুঁজে পাওয়া যায়। সেদিন বলা হয়েছিল, ‘তোমার আমার ঠিকানা / পদ্মা মেঘনা যমুনা।’ অর্থাৎ আমার পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা বিধৌত এই নির্দিষ্ট ভূগোল ভিত্তিক একটি জাতি গোষ্ঠী।