১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ২০২২ সালের মার্চ। সময়ের ব্যবধানে পাঁচ দশকেরও বেশি। গত বছর আমরা স্বাধীনতা ও বিজয়ের পঞ্চাশ বছর ছুঁয়েছি। সাড়ম্বরে ওই মহান অধ্যায়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপিত হয়েছে। একই সঙ্গে সামনে এসেছে পুরোনো কিছু প্রশ্ন নতুন করে। পঞ্চাশ বছর তো কম সময় নয় একটি দেশ ও জাতির জন্য। আমাদের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের পথ মসৃণ ছিল না। স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় কতিপয় বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা, সদস্য ও রাজনৈতিক যোগসাজশে ঘটে বর্বরোচিত ঘটনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় পশ্চাৎযাত্রা। কতরকম অনাকাঙ্ক্ষিত-অপ্রত্যাশিত ঘটনা দফায় দফায় ঘটিয়েছেন তৎকালীন শাসকরা নিজেদের লাভের হিসাব কষে। এর মাশুল গুনতে হয়েছে সমগ্র জাতিকে। সচেতন মানুষ মাত্রই এসব জানেন। দীর্ঘকাল পর অন্ধকার কেটে স্বাধীন দেশটি আবার ফিরে আসে তার স্বপ্নের পথে। তার পরও স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কখনও কখনও প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতার যে দেয়াল দাঁড়ায়, তা প্রশ্নবোধক।
বিগত পঞ্চাশ বছরে নানা প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়েও বিশ্বদরবারে আমরা একটা অবস্থান করে নিতে পেরেছি অন্যরকমভাবে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। একাত্তরে আমরা যেমন শরণার্থী হয়েছিলাম, সেরকমভাবে নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত-নিপীড়িত-নির্যাতিত সর্বহারা লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে আমরা নন্দিত। মানবতার তাগিদে বাংলাদেশ স্থাপন করেছে অনন্য দৃষ্টান্ত। বিশ্বের নানা সূচকে আমাদের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য। অর্থনীতির আকার বড় হয়েছে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, পদ্মা সেতুর মতো এত বড় কর্মযজ্ঞ নিজস্ব অর্থায়নে সম্পন্নের পথে। আরও অনেক মেগা প্রকল্প চলমান। শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে নানা অনিয়ম সত্ত্বেও উন্নয়ন যেটুকু হয়েছে, তাও কম নয়। অর্থাৎ আমাদের অর্জনের খতিয়ান মোটা দাগে বলতে গেলে অনেক বিস্তৃত। কিন্তু এখনও যেসব বিষয় অনার্জিত রয়ে গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন দাঁড়ায়- এর দায় কার। দায় কমবেশি সবার, তবে সবচেয়ে বড় দায় রাজনীতি-সংশ্নিষ্টদের। তাদের অনেকেরই অঙ্গীকার পালনে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থতা ও স্ববিরোধিতা স্পষ্ট। একাত্তরের পূর্বাপর আমাদের রাজনৈতিক অর্জন কতটা- এর ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ নতুন করে নিষ্প্রয়োজন। অনেক অর্জনের বিসর্জন ঘটেছে এও সত্য।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সুনির্দিষ্ট কিছু অঙ্গীকার-প্রত্যয় ছিল। অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, মানুষের অধিকার সব ক্ষেত্রে নিশ্চিতকরণ- এগুলো ছিল অন্যতম। তবে আজও আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। বাহাত্তরের সংবিধানে যে বিষয়গুলো ছিল, জনঅধিকার কিংবা স্বার্থের পরিপূরক সেগুলোতে দফায় দফায় আঘাত করলেন পঁচাত্তর-পরবর্তী শাসকরা নিজেদের স্বার্থে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন আঘাত এলো, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলে কুঠারাঘাত। আজও সেই সংবিধানের পূর্ণ আদিরূপ ফিরে পাওয়া যায়নি জনদাবি সত্ত্বেও। কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না যদি দুর্নীতি, রাজনৈতিক কদাচার, সন্ত্রাস, রাজনৈতিক অস্বচ্ছতার মতো আরও অনেক নেতিবাচকতার নিরসন না ঘটিয়ে শুধু অবিরত উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়। দুর্নীতির ব্যাপারে সরকারের 'শূন্য সহিষ্ণুতা'র অঙ্গীকার সত্ত্বেও প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে যেসব চিত্র উঠে আসছে, তা প্রশ্নবোধকই বটে। এত উন্নয়ন সত্ত্বেও বৈষম্যের ছায়া কেন বিস্তৃত হচ্ছে- এ প্রশ্নের উত্তরও জটিল নয়।