২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস। সুদীর্ঘ দিনের বহু প্রজন্মের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে নিজেদের স্বাধীন জাতি হিসেবে ঘোষণা করার দিন। ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙালির লড়াইয়ের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। স্বাধীনতার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এ জাতি রক্ত দিয়েছে, নিজেদের জীবনকে অকাতরে উৎসর্গ করেছে। সংগ্রামের পথে গৌরবময় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে আত্মাহুতি দিয়েছেন মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার-এর মতো অগণিত সূর্যসন্তান।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের মাধ্যমে পাকিস্তানের জন্মের পরপরই আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত এল প্রথমে। শুরু হলো নতুন লড়াই। সে লড়াই ছিল প্রথমত জাতি হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার। নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াই।
পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা হলেও উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনের সব কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও রাখার দাবি তোলেন। কিন্তু সেই প্রস্তাব পাস হলো না। ঢাকাসহ সারা দেশজুড়ে ক্রমান্বয়ে প্রতিবাদ দানা বাঁধতে থাকে। ১৯৪৮ সালে ২ মার্চ ফজলুল হক হলের এক সভায় শামসুল আলমকে আহ্বায়ক করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।
২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক নাগরিক সংবর্ধনায় পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করলেন, ‘উর্দু অ্যান্ড অনলি উর্দু শেল বি দ্য স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান।’ ২৪ মার্চ কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি একই কথার পুনরাবৃত্তি করলে উপস্থিত ছাত্ররা তাৎক্ষণিকভাবে এর প্রতিবাদ জানায়।
এর আগে ১১ মার্চ ১৯৪৮ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন সে সময়কার উজ্জ্বল ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান, কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুল হক, আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী, অলি আহাদসহ অনেকে। ১১ মার্চের প্রেক্ষাপট থেকেই ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন ও পরবর্তীকালে স্বাধীনতা আন্দোলন বিকশিত হতে থাকে।
৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলার সোনার ছেলেদের রক্তে ভিজে গেল রাজপথ। পুলিশের গুলিতে নিহত হন সালাউদ্দিন, সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ অনেকে। ৫২-এর রক্তাক্ত রাজপথ ধরে একেকটি ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের দাবিতে বাংলার মানুষ ক্রমান্বয়ে উজ্জীবিত হতে থাকে। ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন বাংলার রাজনৈতিক শক্তিকে জানান দিতে সক্ষম হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শরীফ শিক্ষা কমিশন বাতিলের পাশাপাশি কারাবন্দী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মুক্তি নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক চেতনার স্ফূরণ ঘটতে থাকে।