পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে বাংলাদেশে ভূপৃষ্ঠের জলাশয়- নদী, খাল, বিল, ঝিল, হাওর, বাঁওড়, পুকুর প্রভৃতি ব্যবস্থাপনা নিয়ে যত বেশি কথাবার্তা হয়; ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা যেন ততটাই কম। এর মানে এই নয় যে, ভূগর্ভস্থ পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা আমাদের দেশে কম প্রাসঙ্গিক। এটা ঠিক, বিশ্বের অধিকাংশ দেশের তুলনায় আমাদের ভূপৃষ্ঠের পানিসম্পদ যে কোনো বিবেচনাতেই পর্যাপ্ত। এত নদনদী, খাল-বিল বিশ্বের আর কোথায় আছে? কিন্তু সুপেয় পানি কিংবা সেচ- সর্বক্ষেত্রে মূল ভরসা ভূগর্ভস্থ পানিই। একটি গবেষণা বলছে, ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের দিক থেকে বিশ্বে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
অবশ্য বাংলাদেশে শুধু নয়; বিশ্বজুড়েই যে ভূগর্ভস্থ পানিসম্পদের গুরুত্ব ও ব্যবস্থাপনা যথাযথ মনোযোগ পাচ্ছে না- এ বছর বিশ্ব পানি দিবস প্রতিপাদ্যে তা স্পষ্ট। ইংরেজিতে এবারের প্রতিপাদ্য 'গ্রাউন্ডওয়াটার- মেকিং দ্য ইনভিজিবল ভিজিবল'। অর্থাৎ অদৃশ্য হয়ে থাকা ভূগর্ভস্থ পানিকে দৃশ্যমান করতে হবে। যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বাণী- 'বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে'।
আমাদের দেশের পানি ব্যবস্থাপনার 'অন্তরে' কীভাবে মূলত ভূগর্ভস্থ পানিই বিরাজমান; একটি উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। ঢাকা ওয়াসা নাগরিকদের জন্য যে সুপেয় পানি সরবরাহ করে, এর অন্তত ৭১ শতাংশ আসে মাটির নিচ থেকে। যদিও প্রতিবছর আলোচনা হয় ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহার বাড়ানো নিয়ে। পানি শোধন প্রকল্পের সংখ্যা ও ব্যয় বাড়তে থাকে; বুড়িগঙ্গা নষ্ট করে শীতলক্ষ্যা এবং শীতলক্ষ্যার পর মেঘনার দিকে পাইপের দৈর্ঘ্য বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে প্রতিশ্রুতির বহর। বাড়ে না কেবল ভূপৃষ্ঠের পানির ব্যবহার।
ঢাকা নগরী এখনও চারপাশে নদী দিয়ে ঘেরা। অথচ যে কোনো নগরীর একদিকে নদী থাকলেই সেটা 'সৌভাগ্যবতী' আখ্যা পায়। সেদিক থেকে ঢাকা চার গুণ সৌভাগ্যের অধিকারী। এর অভ্যন্তরেও প্রবাহিত ছিল একাধিক নদী ও অর্ধশতাধিক খাল। আর বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিল, ঝিল ও জলাভূমি। সেগুলো নির্বিচারে নষ্ট করে আমরা নির্বিকারচিত্তে মাটির নিচের পানি তুলে চলেছি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূগর্ভস্থ পানিস্তর শূন্য হলে ভূমিকম্প ও ভূমিধসের ঝুঁকি থাকে ষোল আনা। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম ও রাজশাহী ওয়াসার পরিস্থিতিও তথৈবচ। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে গত দুই দশকে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বোতল পানি কোম্পানির পাম্পের হিসাব। যোগ করতে হবে বিভিন্ন শিল্প, বাণিজ্যিক ও সেবামূলক স্থাপনায় বসানো ব্যক্তি খাতের পাম্পগুলোর সংখ্যা। গ্রামাঞ্চলে পুকুর ক্রমেই বিলুপ্ত হয়ে আক্ষরিক অর্থে ঘরে ঘরে বসা টিউবওয়েলের মাধ্যমে তোলা গৃহস্থালি পানির পরিমাণও একত্রে হিসাব করলে বিশাল অঙ্ক হিসেবে দাঁড়াবে। বস্তুত বাংলাদেশের নদীগুলো দিয়ে যত
পানি বয়ে যায়; মাটির নিচ থেকে তোলা পানির প্রবাহ তার থেকে কম না বেশি- গবেষকরা তুলনা করে দেখতে পারেন।
আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। আবহমানকাল থেকে কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের প্রধান শস্য ধানের প্রধান মৌসুম ছিল বর্ষাকাল ঘিরে। বর্ষার আগে হলে আউশ, আর পরে হলে আমন। কথিত সবুজ বিপ্লবের নামে এলো কৃত্রিম সেচ ব্যবস্থা। ভূপৃষ্ঠের জলাভূমি থেকে কায়িক সেচ ব্যবস্থার জায়গায় এলো ভূগর্ভস্থ পানি তোলার পাম্প। প্রথমে ডিপ টিউবওয়েল, তারপর শ্যালো টিউবওয়েল। আশির দশকেও যেখানে কমবেশি পাঁচ হাজার ডিপ টিউবওয়েল ছিল; এখন সেটা ১৫ হাজার ছাড়িয়েছে। শ্যালো টিউবওয়েলের 'প্রবৃদ্ধি' আরও ব্যাপক। আশির দশকের দুই লাখ শ্যালো টিউবওয়েল মাত্র চার দশকে আট গুণ বেড়ে ১৬ লাখ ছাড়িয়েছে। এসব যে নিছক সংখ্যা নয়, বরং ভূগর্ভস্থ পানিসম্পদের ওপর ক্রমাগত চাপ বৃদ্ধির সূচক- এটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে এসেছে আরও দুটি প্রপঞ্চ। নির্মম পরিহাসের বিষয়, কথিত সবুজ বিপ্লবের মতো এগুলোও এসেছে উন্নয়নের নামে। এই নিবন্ধ যেদিন লিখছি, সেদিনই দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এই বিদ্যুতায়ন নিঃসন্দেহে ফসলের মাঠে মাঠেও পৌঁছে গেছে। সেচের কাজে ব্যবহূত হচ্ছে। ফলে আগে যেখানে ডিজেলচালিত পাম্প দিয়ে ভূগর্ভস্থ পানি তোলা হতো; ডিজেলের খরচ বিবেচনায় একটা 'চেক অ্যান্ড ব্যালান্স' থাকত। বিদ্যুৎচালিত পাম্পের ব্যয় অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন স্বাভাবিকভাবেই বাড়ছে। পাশাপাশি প্রচলিত বিদ্যুতের তুলনায় 'সবুজ' বা পরিবেশসম্মত সৌরবিদ্যুৎ চালিত পাম্পও গত কয়েক বছর ধরে সম্প্রসারিত হচ্ছে। তার মানে, সেখানেও পরিবেশ রক্ষার নামে আসলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বৃদ্ধির মতো পরিবেশ-বৈরী ব্যবস্থা?