আমাদের দেশে অসংখ্য নদী আছে, যেখানে আড়াআড়িভাবে সেতু ছাড়া সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। গণমাধ্যমে আমরা মাঝেমধ্যে দেখি সড়কসেতু আছে, সংযোগ সড়ক নেই। আবার অনেক অপরিকল্পিত সেতু আছে, যেগুলোয় বাস–ট্রাক চালানো যাচ্ছে না। কিন্তু এমন নদী খুব কম আছে, যেখানে নদীর প্রস্থের চেয়ে ছোট করে সেতু নির্মাণ করা হয়নি। সেতু নির্মাণ করার সময় বিদ্যমান নদী কিংবা সিএস নকশা অনুযায়ী নদী—কোনোটিকেই আমলে নেওয়া হচ্ছে না। রংপুরের বুড়াইল, বাইশাডারা শ্যামাসুন্দরী, খোকসা ঘাঘট, ঘাঘট, শালমারা, আলাইকুমারী নদ ও নদীতে প্রস্থের চেয়ে ছোট করে সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। পাবনার ইছামতী নদীর ওপর প্রায় অর্ধশত সেতু আছে, যার প্রতিটি নদীর প্রস্থের চেয়ে ছোট করে নির্মাণ করা। বলা যায় দেশের সর্বত্রই অভিন্ন অবস্থা।
নদীর প্রস্থের চেয়ে ছোট করে সেতু নির্মাণ করার সঙ্গে সঙ্গে দুই পাড়ের দখলদারেরা নড়েচড়ে বসেন। তাঁরা ধীরে ধীরে সেতুর সীমানাকে নদীর মাপ ধরে নিয়ে দুপাড় ভরাট করেন, স্থাপনা নির্মাণ করেন। নদীর প্রস্থের চেয়ে ছোট সেতু হওয়ার কারণে অনেক সময় জলাবদ্ধতাও দেখা দেয়। রংপুর শহরের জলাবদ্ধতার এটি একটি কারণ। নদীর চরম সর্বনাশের যে কয়টি কারণ আছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো, প্রস্থের তুলনায় ছোট সেতু নির্মাণ করা।
নদীর ওপর এবং পাশে যেকোনো স্থাপনা নির্মাণ করার সময় নদীর জীবনের কথাও ভাবা প্রয়োজন। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী এখন নদী আইনগতভাবেও জীবন্ত সত্তা। এই জীবন কিসে বাঁচবে, কিসে স্বাস্থ্যবান থাকবে, তা না ভেবে কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত নয়। জনজীবনে নদীর উপযোগিতার কথা ভাবতে হবে। নদীগুলোকে জলপথ হিসেবে ব্যবহার করতে হলে সেতুগুলোর উচ্চতা বিবেচনায় নিতে হবে। এটি অনেক ক্ষেত্রেই নেওয়া হচ্ছে না। এমনকি যেসব নদীতে লঞ্চ, স্টিমার ও বড় নৌকা চলে, সেখানেও সেতুর উচ্চতার কথা ভাবা হচ্ছে না। সে কারণে বর্ষায় যখন নদীর পানি অনেক বেড়ে যায়, তখন জলযান চলাচল ব্যাহত হয়। কী আজব দেশ! নৌপথকে মেরে ফেলার যেন প্রাণান্তকর চেষ্টা!
অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন আর অপরিণামদর্শী আমাদের দেশের সেতু নির্মাণসংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহ। যাঁরা সড়ক বিভাগে কাজ করেন, তাঁরা সড়কটুকুই শুধু চোখে দেখেন। সড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে নদীর ওপর কতখানি নির্যাতন করা হচ্ছে, তা দেখছেন না। নৌ পরিবহনমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ পঞ্চগড় থেকে সমুদ্র পর্যন্ত নৌপথ চালু করতে চান। এটি সম্ভব। কিন্তু এই কাজ করতে গেলে অসংখ্য সেতু ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। অজ্ঞতা, অসচেতনতা আর উপেক্ষাপ্রবণতার কারণে আমাদের দেশের নদীর পরিচর্যায় সরকার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বর্তমান সরকার নদীর প্রতি কিছুটা সদয়। তারপরও সেতুর প্রশ্নে সরকারের আন্তরিকতা অনেকটাই বুলিসর্বস্ব।