ইউনাইটেড ন্যাশন এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (UNEP) ও ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রণীত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার জরিপ মোতাবেক বিশ্বে প্রতিবছর উৎপাদিত ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন টন খাবার অপচয় হয় বা নষ্ট করে ফেলা হয়। এ অব্যবহৃত বা অপচয়কৃত খাবারের ৪৫ শতাংশ হলো শাকসবজি ও ফলমূল, ৩৫ শতাংশ মাছ ও সামুদ্রিক খাবার, ৩০ শতাংশ খাদ্যশস্য, ২০ শতাংশ দুগ্ধজাত খাবার এবং ২০ শতাংশ মাংস। এ অপচয়ের মূল কারণ লুকিয়ে আছে খাদ্য উৎপাদনে বা খাদ্যের সুষম ব্যবহার পদ্ধতিতে। টাকার অঙ্কে এ অপচয়ের পরিমাণ প্রায় এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। ক্যালরির হিসাবে প্রতি চার ক্যালরির এক ক্যালরির সমপরিমাণ খাদ্য অপচয় হয়। আমরা এমন এক বিশ্বে বসবাস করছি যেখানে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ক্ষুধা ও অপুষ্টি এক চিরন্তন সত্য, খরা, যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে মাইগ্রেশন বা অভিবাসন, খাদ্যসামগ্রীর ঊর্ধ্বমূল্য, সামাজিক অস্থিরতা, বঞ্চনা, বৈষম্যমূলক বণ্টন ব্যবস্থার কারণে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে এবং মৃত্যুবরণ করছে, সেই পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের এ অসহনীয় অপচয় মর্মান্তিক ও দুর্ভাগ্যজনকই শুধু নয়, নৈতিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দিক থেকেও এক জঘন্য মানবিক অপরাধ।
প্রতি বছর শিল্পোন্নত দেশগুলোতে যে পরিমাণ খাদ্যের অপচয় হয়, তা সাব সাহারা অঞ্চলে উৎপাদিত মোট খাদ্যের প্রায় সমান, অঙ্কের হিসাবে যা ২৩০ মিলিয়ন টন। বিশ্বব্যাপী যত খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয় তার অর্ধেক অর্থাৎ ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন টন খাদ্য বিনষ্ট হয় নতুবা অপচয় হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ৩০-৪০ শতাংশ খাদ্যের অপচয় হয় যা গড়ে প্রতি মাসে প্রতিজনের ২০ পাউন্ড খাবারের সমান। আমেরিকানরা প্রতিবছর ১৬৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের খাবার ফেলে দেয় বা ধ্বংস করে। আপনারা শুনে আশ্চর্য হবেন, যুক্তরাজ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ ফলমূল ও শাকসবজি বাজারে না পাঠিয়ে খেতেই ফেলে রাখা হয় বা নষ্ট করে ফেলা হয়। দেখতে নিখুঁত, আকর্ষণীয় ও কসমেটিক মানের না হওয়ার কারণে ক্রেতারা এসব শাকসবজি ও ফলমূল কিনতে চায় না বা কেনে না বলে কৃষকরা এসব ফলমূল ও শাকসবজি জমিন থেকে তোলে না বা জমিনেই নষ্ট করে ফেলে। যুক্তরাজ্যে ২০০৯ সালে যে পরিমাণ শস্য ও রুটি ফেলে দেওয়া হয়েছে বা অপচয় করা হয়েছে, তা দিয়ে বিশ্বের তিন কোটি মানুষের অপুষ্টি দূর করা যেত।
বিশ্বে প্রতিদিন প্রতিজনের জন্য ৪ হাজার ৬০০ কিলোক্যালরির সমপরিমাণ ফসল ফলানো হয়। কিন্তু গড়ে তার অর্ধেকেরও কম ব্যবহৃত হয় বা খাওয়া হয়, বাকি অংশ অপচয় হয় বা নষ্ট হয়। উত্তর আটলান্টিক ও উত্তর সাগরে ২ দশমিক ৩ মিলিয়ন (২৩ লাখ) টন ধৃত মাছ ফেলে দেওয়া হয় বা নষ্ট করে ফেলা হয়। ইউরোপে যত মাছ ধরা হয় তার ৪০-৬০ শতাংশ ফেলে দেওয়া হয় এ কারণে যে, সেগুলো সঠিক আকার-আকৃতির হয় না, ভিন্ন প্রজাতির হয়, নতুবা কোনো না কোনোভাবে ত্রুটিযুক্ত হয় যা বাজারে পাঠানো বা খাওয়ার মানসম্মত হয় না। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাব মোতাবেক, বিশ্বে যে পরিমাণ খাবারের অপচয় হয় তা দিয়ে ৩০০ কোটি অভুক্ত মানুষের খাবারের সংস্থান করার পরও উদ্বৃত্ত খাবার দিয়ে বিশ্বের দরিদ্র দেশের মানুষের ১৩০ শতাংশ পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা যেত। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার অন্য এক হিসাবমতে, বিশ্বের উৎপাদনশীল জমিতে প্রতি বছর যে পরিমাণ খাবার পরিত্যক্ত হয় বা নষ্ট করা হয়, তাতে ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন টন গ্রিন হাউজ গ্যাস উৎপন্ন হয়, নষ্ট হয় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন হেক্টর জমি যা বিশ্বের ফসল উৎপাদনযোগ্য জমির পরিমাণের প্রায় ২৮ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের এক হিসাবে বলা হয়েছে, বিশ্বে উৎপন্ন মোট গ্রিন হাউজ গ্যাসের ১০ শতাংশ উৎপন্ন হয় এমন সব খাবারের উৎপাদন, সরবরাহ ও সংরক্ষণের জন্য, যা আদৌ খাওয়া হয় না।
২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের মোট লোকসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন অর্থাৎ ৯৬০ কোটি। এর মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ আসবে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে এবং অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান লোকসংখ্যার অর্ধেক আসবে শুধু আফ্রিকা থেকে। জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞরা ভেবে কূল পাচ্ছেন না, এসব মানুষের খাবারের সংস্থান হবে কীভাবে! জাতিসংঘের মতে, এ সমস্যা সমাধানের জন্য বাড়তি খাদ্য উৎপাদনের দবকার হবে না। বিশ্বব্যাপী খাবারের যে অপচয় হয় তা রোধ করা গেলে এবং সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা করা গেলে বিশ্বের কাউকেই না খেয়ে থাকতে হবে না।