সাহিত্যে কথা বলি, কী বলি রাজনীতির কথা, কৃষকের উপস্থিতি কোথাও নিষিদ্ধ নয়, তবু একটা নিষেধ থাকে। অলিখিত। নিষেধটা শ্রেণির। কৃষক সাহিত্য সৃষ্টি করে না, রাজনীতিও তার নিয়ন্ত্রণে থাকে না; সাহিত্যে যেমন, রাজনীতিতেও তেমনি, কর্তৃত্ব অকৃষকদের। এরা কৃষকদের জানে, তার দুঃখে সহানুভূতি জানায়, আর পক্ষে কথাও বলে। কিন্তু কৃষকের জন্য যে জায়গা করে দেবে, তা পারে না। নিষেধ আসে বিচ্ছিন্নতা ও দূরবর্তিতা থেকে; দুর্লঙ্ঘ্য হয়ে দাঁড়ায় স্বার্থের পাহারাদারি। কৃষক ও অকৃষকদের স্বার্থ দেখা যায় পরস্পরবিরোধী।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে কৃষকের দুঃখের সংক্ষিপ্ত কিন্তু মর্মস্পর্শী বিবরণ আছে বঙ্কিমচন্দ্রের লেখাতে। কৃষক তার উপন্যাসে নায়ক হবে- এটা সম্ভব ছিল না। নায়ক জমিদাররাই এবং জমিদারদের জীবনযাপনে কৃষক প্রান্তবর্তী বটে; বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসেও সেট সত্য। কিন্তু প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদেশের কৃষকদের দুর্দশায় অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত। সেই দুর্দশার খরালোকে তার প্রবন্ধে জমিদারদের বিলাসবাহুল্য নিতান্ত কুৎসিত ঠেকে। শ্রেণিবিভাজনের বিষয়টা বঙ্কিমচন্দ্র অত্যন্ত পরিস্কারভাবে জানতেন। জমিদার যে কৃষকের শত্রু প্রবন্ধে তা অত্যন্ত পরিস্কার করে বলেছেন। জমিদারি ব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করেছে ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং সে-ব্যবস্থাই বঙ্গদেশের কৃষকের সর্বনাশের জন্য দায়ী। এ সত্য অত্যন্ত পরিচ্ছন্নরূপে তার লেখাতে উপস্থিত। এই সূর্যের চারপাশেই অন্যসব গ্রহ-উপগ্রহের ঘূর্ণিবাজি, জানিয়েছেন তিনি। তবু 'বঙ্গদেশের কৃষক' প্রবন্ধের উপসংহারে এসে তিনি লিখেছেন, '১১৯৩ সালে যে ভ্রম ঘটিয়াছিল এক্ষণে তাহার সংশোধন সম্ভব না। সেই ভ্রান্তির উপর আধুনিক বঙ্গসমাজ নির্মিত হইয়াছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ধ্বংসে বঙ্গসমাজে ঘোরতর বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইবার সম্ভাবনা। আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি।'
প্রথমে ঘটবে বিশৃঙ্খলা, পরে দেখা দেবে বিপ্লব- এই রকমের আশঙ্কা। অসামান্য বঙ্কিমচন্দ্রও তার শ্রেণির মানুষই রয়ে গেছেন, শেষ পর্যন্ত; সীমান্ত লঙ্ঘনের বৈপ্লবিক ঘটনাটি ঘটেনি। বরং তিনি সংকুচিত হয়ে গেছেন। বিপ্লবকে পাছে সহায়তা করা হয় তাই 'সাম্য' নামে জনপ্রিয় বইটি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, মীর মশাররফ হোসেনের নাটক 'জমিদার দর্পণ'-এর প্রশংসা করে বইটিকে প্রচার না করতে লেখককে সৎপরামর্শ দিয়েছেন। শঙ্কা ওই একই, পাছে অশান্ত কৃষক উস্কানি পেয়ে যায়। জমিদারি ব্যবস্থা অপসারণের 'কুপরামর্শ' তিনি ইংরেজদের দিতে পারেননি। কারণ, তার মতে, ওই কাজ করলে ইংরেজরা 'মিথ্যাবাদী' প্রমাণিত হবে এবং 'প্রজাবর্গের অবিশ্বাসভাজন' হয়ে পড়বে। বলেছেন, 'যেদিন ইংরেজের অমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হইব, সমাজের অমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হইব, সেদিন সে পরামর্শ দিব।' ইংরেজের মঙ্গল ও উঠতি মধ্যবিত্ত বাঙালির উন্নতি যে একসূত্রে গাঁথা- এমন স্পষ্ট সত্য বঙ্কিমচন্দ্রের মতো সত্য-উন্মোচনকারী লেখকের পক্ষে চেপে রাখা অসম্ভব ছিল বৈকি।