জানি অনেকেই হয়তো বলবেন যে কবি-সাহিত্যিকরা তো ভাষার নিয়ম তেমনভাবে রক্ষা করেন না। জীবনানন্দ তো রীতিমতো তার একটি কবিতার নামই করলেন, 'আশ্চর্য বিস্ময়'; কিন্তু আমরা যারা সাধারণ মানুষ তাদের পক্ষে এই নিয়ম লঙ্ঘন আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়াতে পারে। জীবনানন্দের 'আশ্চর্য বিস্ময়' নামকরণের পেছনে যে শাব্দিক ব্যঞ্জনা রয়েছে তাতো কেবল কবিকেই শোভা পায়, তাই বলে আমরা যদি বলি, যেমনটি অনেকেই আজকাল বলেন, 'করোনাকালীন সময়' তাতে ব্যঞ্জনা নয়, গঞ্জনা পাবার আশঙ্কা থেকে যায়। ভাষাকে নদীর সঙ্গে তুলনা করেও বলতে পারি যে বহতা নদীকে যদি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয়, তা হলে সেই নদী দুকূল প্লাবিত করে ফেলতে পারে। ভাষাও যদি নিয়মের নিগড় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে পড়ে, তা হলে প্রত্যেক মানুষের ভাষা হয়ে উঠবে ভিন্ন এবং কয়েক শতকের মধ্যেই পরস্পর দুর্বোধ্য। সে জন্যেই বোধ করি ভাষাতত্ত্বের এই দুই প্রান্তবর্তী মতবাদের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে, ভাষার উন্নতিকে নিশ্চিত করা যায়।
বাংলা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সম্প্রতি যে ত্রুটি-বিচ্যুতি আমরা লক্ষ করি, তার সবটাই অজ্ঞতাপ্রসূত নয়, বরং ইংরেজি থেকে অনুবাদের কারণেও কিছু কিছু দৃষ্টিগ্রাহ্য ভুল ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে। যারা এ ধরনের শব্দ বা বাক্য বিন্যাস ব্যবহার করছেন, তাদের আপাতদৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় যুক্তি হচ্ছে ভাষার সরলীকরণ। প্রকৃতপক্ষে এক ধরনের ভিন ভাষার প্রভাব থেকেই এসব পরিবর্তন লক্ষ করি। ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে যাকে ভাষাতাত্ত্বিকরা মাদার টাং ইন্টারফেরেন্স বলে থাকেন এবং সেই মাতৃভাষার কারণে ইংরেজি ভাষা ব্যবহারে যেমন ছাত্রছাত্রীরা ভুল করে থাকেন, বাংলা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বলা যায় একধরনের ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারফেরেন্স বা বিদেশি ভাষার প্রভাব আমরা ইদানীং লক্ষ করি।
যেমন ধরুন, ঢাকা ও কলকাতার সংবাদপত্রের শিরোনামে এবং ইদানীং সংবাদের ভেতরেও আমরা দেখি সংখ্যাবাচক শব্দের প্রয়োগে যে সহজ পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে তা যে কেবল ব্যাকরণসম্মত নয়, তা-ই নয়, তা শ্রুতিগ্রাহ্যও নয়। যেমন ধরুন, চার ডাকাত খুন, পাঁচ পুলিশ আহত। বাংলা ভাষায় সংখ্যাবাচক বিশেষণ ব্যবহারের একেবারে মূল নিয়মটিই এই সরলায়নে বিনষ্ট হচ্ছে। ইংরেজিতে সংখ্যাবাচক বিশেষণের পর আর কিছু লেখার দরকার নেই, সংশ্নিষ্ট বিশেষ্য ছাড়া। কিন্তু বাংলায় এই সংখ্যাবাচক বিশেষণের পর, পরিমাপের একক ব্যবহার করতে হয়, অথবা টা, টি, গুলো, গুলি এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করতে হয়। বাংলা ভাষায় জন শব্দটির দুটি অর্থ। একটি অর্থে জন হচ্ছে মানুষ আর অন্য অর্থে আবার এই জন হচ্ছে মানুষ পরিমাপের একক। সে জন্যেই তিনজন, চারজন ব্যবহূত হয় এবং সেই কারণেই চারজন লোক কথাটি ভুল নয়, কারণ এখানে 'জন'-এর অর্থ লোক নয়, এটি লোক পরিমাপের/গণনার একক। সংখ্যাবাচক বিশেষণের সঙ্গে অতএব পরিমাপের একক ব্যবহার না করলে, সেটি শুদ্ধ বলে ধরে নেওয়া যায় না। আজকাল অবশ্য বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্রে এ নিয়মটির ব্যত্যয় ঘটছে। ভাষাকে সরল করার উদ্দেশ্যে এই পরিবর্তন আনা হচ্ছে, নাকি এই প্রভাব ও অনূদিত সংস্কৃতির অংশ সেটি বোঝার প্রয়োজন রয়েছে।