শুরুতেই একটি চিত্রকল্প। স্থান : কুমিল্লা-ত্রিপুরা সীমান্তে শালদা নদীর তীরবর্তী রণাঙ্গন। সময় : ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বরের কোনো একদিন। বেলা দ্বিপ্রহর। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের পূর্ব পার্শ্বে মুক্তিবাহিনী ও পশ্চিম পার্শ্বে খানসেনারা। তুমুল লড়াই চলছে উভয় পক্ষে। একেবারে মুখোমুখি যুদ্ধ। দুই মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু রশীদ আর বিমল অস্ত্রহাতে নিজ নিজ পজিশন থেকে অবিরাম গুলি ছুড়ছে শত্রুদের লক্ষ্য করে। এরা দুজন ছিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের বি.এ. ক্লাসের ছাত্র। দুজনের বাড়িও একই গ্রামে, শহর থেকে মাইল তিনেক দূরে। ছোটবেলা থেকে দুজন শুধু সহপাঠী নয়, একেবারে জানী দোস্ত। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কাউকে না জানিয়ে দুজনে সল্লা করে একদিন রাতের অন্ধকারে কুমিল্লা শহরের কাছেই বিবির বাজার বর্ডার দিয়ে সোজা মেলাঘর। সেখানে অন্যদের সঙ্গে তাদেরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিয়ে নিলেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার। তারপর মাসখানেক ট্রেনিংয়ের পর শুরু হলো ছোটখাটো অপারেশনে অংশগ্রহণ। বড় লড়াইয়ে আসা হয়েছে এবারই। দুই বন্ধু কাছাকাছি পজিশন থেকে যুদ্ধ করছে। একজনের কাছ থেকে আরেকজনের অবস্থান মাত্র হাত দশেক দূরে। ফলে দুজনেই মাঝে মাঝে ফিসফিস করে কথা বলছে। ‘জানিস বিমল, এই বড় বড় গোলা আসছে কোত্থেকে?’ রশীদ জানতে চাইল। বিমল বলল, ‘ঠিক বলতে পারব না।’ ‘সি অ্যান্ড বি রোডের ওপর যে কালামুড়ার ব্রিজ আছে না, সুবেদার সাহেব বলেছেন সেখানে ব্যাটারা নাকি বিরাট একটা বাঙ্কার বানিয়েছে। ওখান থেকেই সেই সকাল থেকে থেমে থেমে শেলিং করছে জানোয়ারগুলা।’ রশীদের কথা শেষ হওয়ার আগেই বিকট শব্দ করে একটা গোলা পড়ল তার পজিশনের কাছে। অমনি ‘মাগো’ বলে আর্তনাদ করে উঠল রশীদ। একটা স্প্লিন্টার বুকের বাঁ পাশটায় আঘাত করেছে। সঙ্গে সঙ্গে গলগল করে বুকের লাল তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল। প্রাণপ্রিয় বন্ধুর এই অবস্থা দেখে বিমল রাইফেল হাতে দ্রুত হামাগুড়ি দিয়ে পৌঁছে গেল রশীদের কাছে। রশীদ তখন যন্ত্রণায় কুঁকড়ে কুঁকড়ে বলছে, ‘তুই কোনো গাছের আড়ালে চলে যা, বিমল। তোকে বাঁচতে হবে। স্বাধীন করতে হবে দেশকে।’ ঠিক তখনই আরেকটি শেল এসে পড়ল ওদের কাছে। সঙ্গে সঙ্গে ‘মাগো’ বলে লুটিয়ে পড়ল বিমল। তারও বুকে স্প্লিন্টার ঢুকে পড়েছে। বইতে শুরু করেছে তাজা রক্তস্রোত। যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে দুই বন্ধু জোরে একবার ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠল। দুজনের প্রবহমান রক্তধারা মিশে গিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে যেন ছুটে চলল স্বপ্নের জয় বাংলার দিকে। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে ওখানেই শহীদ হলো তারা। তাদের দুজনের মিলিত রক্তস্রোত মাস তিনেক পরেই জন্ম দিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। সেদিন এই দুই শহীদের মা-বাবারা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করে কেঁদেছিলেন পুত্রশোকে। আর দেশের হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খৃস্টান আপামর জনসাধারণ তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নির্মাণ করেছিল শহীদ মিনার। শহীদদের উদ্দেশে তাদের কণ্ঠে ছিল কালজয়ী মন্দ্রগীত : এক সাগর রক্তের বিনিময়ে/বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা/আমরা তোমাদের ভুলব না।