স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে এ দেশের রাজনীতিকদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। একটি সময় ছিল যখন গণমানুষের রাজনীতি করা মানুষরা জনগণের জন্য কাজ করতে গিয়ে আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়তেন। অনেকে সহায় সম্পদ হারাতে থাকতেন। এতেই তাদের আনন্দ ছিল। আর আজকাল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজনীতি করার অর্থ হচ্ছে নানা উপায়ে সম্পদশালী হওয়া। বঙ্গবন্ধু জীবদ্দশায় রাজনীতিকদের স্খলন দেখে কম মনস্তাপ করেননি। ১৯৭৫ উত্তর রাজনীতি আরও অন্ধকারে নিপতিত হয়। এখন অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতিকদের মধ্যে আদর্শ খুঁজে পাওয়া কঠিন।
রাজনীতি বিষয়টি মানব জীবনের সমান বয়সী নয়। অর্থাৎ মানব জন্ম ও পৃথিবীতে তার বিচরণের অনেক পরে রাজনীতির ধারণা ও কাঠামো তৈরি হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষ শিকারের প্রয়োজনে গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের সূচনা করেছিল। নবোপলীয় যুগে কৃষিসভ্যতার সূচনায় দলবদ্ধ হতে হয়েছিল মানুষকে। শক্তি ও বুদ্ধির বিবেচনায় সে সময়ও গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের মধ্য থেকে দলপতির অবস্থানের কথা জানা যায়। কিন্তু তখনো রাষ্ট্রের ধারণা স্পষ্ট না হওয়ায় রাজনীতির জন্ম হয়নি। এরপর প্রাগৈতিহাসিক যুগ পেরিয়ে মানুষ যখন নগরসভ্যতার পত্তন ঘটায় তখন স্বাভাবিকভাবেই জীবন নির্বাহ, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কাঠামোর বিন্যাস সবকিছুর সুনিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়ন্ত্রক বা পরিচালক গোষ্ঠীর প্রয়োজন অনুভূত হয়। এভাবেই রাজা-মন্ত্রীর ধারণার মধ্য দিয়ে রাজনীতির যাত্রা শুরু হয়। রাজতন্ত্রের ধারণার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও সময়ের বাস্তবতায় অঞ্চলভেদে কখনো অভিজাততান্ত্রিক, প্রজাতান্ত্রিক, একনায়কতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক নানা ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়েছে। তবে জন্মকাল থেকে শুরু করে বহুকাল পর্যন্ত রাজনীতির আভিজাত্য ছিল। রাজনীতিবিদরা সমাজের মানুষের চোখে নমস্য ছিলেন। তারা এখনকার অনেক রাজনীতিকের মতো ভুঁইফোড় প্রতিশ্রুতিবাজ ছিলেন না। তারা রীতিমতো রাজনীতিচর্চা করে নিজেদের যোগ্য করে তুলতেন। জনকল্যাণই যে রাজনীতিকের ব্রত এটা বিশ্বাস করতে চাইতেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছার প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নানা চেষ্টা সব সময়ই চলত, তবে জনগণকে অস্বীকার করে নয়। এ কারণে আধুনিক যুগের সূচনায় ইউরোপে প্রজাতন্ত্র-অভিজাততন্ত্র ভেঙে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও বিশ্ব ইতিহাস একে নিন্দার্থে দেখেনি। বলেছে Enlightened Despotism বা বুদ্ধিদীপ্ত স্বৈরাচার। অর্থাৎ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার ভঙ্গুর দশা যখন সমাজ জীবনকে শান্তি দিতে পারছিল না তখন ক্ষমতা দখল করেন যিনি, তিনি তার স্বৈরাচারী শক্তিতে সব ঘুণে ধরা কাঠামো ভেঙে শক্ত হাতে জনকল্যাণমুখী শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। অর্থাৎ রাজনীতির আদর্শ যে জনকল্যাণ এ সত্য কোনো ব্যবস্থার রাজনীতিবিদরাই বিস্মৃত হননি।