গত ৪ আগস্ট একটি দৈনিকে 'জলজীবিকার হাতিয়ার বারকি' শিরোনামে প্রকাশিত ফিচারটি আমাকে আকৃষ্ট করেছে। 'বারকি' শব্দটি দেখে আমার কৌতূহল বেড়ে গেল। কারণ আশির দশকের প্রথমদিকে আমি বেশ কয়েক বছর গ্রামীণ গবেষণার কাজে নোয়াখালীর গ্রামে অবস্থান করেছিলাম। আমার গবেষণার মূল বিষয় ছিল বিভিন্ন রকমের বাজারে গ্রামীণ গৃহস্থালির বিনিময় সম্পর্ক বোঝার চেষ্টা করা। বিভিন্ন বাজার বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছি পণ্যের বাজার, শ্রমের বাজার এবং ঋণের বাজার। বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে এসব বাজার একে অপরের থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। পণ্যের বাজারে গ্রামীণ পরিবারগুলো নানা ধরনের কৃষিপণ্য, জলজ পণ্য যেমন মাছ ও কাছিম, বৃক্ষজাত পণ্য যেমন ফল-ফলাদি ও জ্বালানি কাঠ এবং পশুজাত পণ্য যেমন দুগ্ধ, মাংস, হাঁস-মুরগি, ডিম প্রভৃতি বিক্রয় করে। আবার অনেক গৃহস্থালি, যাদের এসব পণ্য নেই কিন্তু প্রয়োজন অনুভব করে, তারা এগুলো পণ্যের বাজার থেকে ক্রয় করে। আমার অনুসন্ধানের বিষয় ছিল এসব পণ্য কী শর্তে বেচাকেনা হয়। যেমন এগুলোর পরিমাণ, দাম, ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে সম্পর্ক, কত দূরের হাট থেকে এগুলো সংগ্রহ করা হয়, হাটে ইজারাদারকে কী পরিমাণ অর্থ দিতে হয়, পণ্য কোথা থেকে এসেছে, পণ্য নিয়ে দরকষাকষি কেমন ছিল ইত্যাদি। একইভাবে গ্রামীণ গৃহস্থালি শ্রমের বাজারে কী শর্তে শ্রম বেচাকেনা করেছে, যেমন মজুরির প্রকৃতি কী ছিল অর্থাৎ এর জন্য কী পরিমাণ নগদ টাকা পাওয়া গেছে অথবা দিতে হয়েছে, শ্রম ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ধরনটি কী, কত ঘণ্টার জন্য কাজ করতে হয়েছে অথবা মজুর ভাড়া করতে হয়েছে, যারা শ্রম দিয়েছে তারা কোথা থেকে এসেছে অর্থাৎ গ্রাম থেকে, গ্রামের বাইরে অন্য গ্রাম থেকে, উপজেলারও বাইরে থেকে অথবা মৌসুমি পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে। ঋণের বাজারে জানতে চেয়েছি কত টাকা ঋণ করা হয়েছে অথবা ঋণ দিয়েছে, ঋণের জন্য কী হারে সুদ দিতে হয়েছে, সুদের ধরন কী ছিল- যেমন নগদ টাকায় শ্রম দিয়ে অথবা পণ্য দিয়ে। কী উদ্দেশ্যে ঋণ করা হয়েছিল, ঋণ বিনিয়োগ করে কী পরিমাণ লাভ-ক্ষতি হয়েছে, রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে ঋণ পাওয়ার জন্য আইনগতভাবে সুদ ছাড়াও কী পরিমাণ উপরি ব্যয় করতে হয়েছে এবং ঋণদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে সম্পর্কের ধরন কী ছিল। পণ্যের বাজারে সেবারও লেনদেন হয়। সেবার ধরনটি কী, এর জন্য কী কী শর্তে লেনদেন হয়েছে। আমি যখন গবেষণা করছিলাম তখন গ্রামে ঝাড়-ফুঁক, পানিপড়া দেওয়া এবং তাবিজ-কবজ দেওয়ার মতো কর্মকাণ্ড প্রচলিত ছিল। যদিও এসব নিছক কুসংস্কার; তা সত্ত্বেও এসব কাজ করে খন্দকার নামক এক শ্রেণির পেশাজীবী প্রচুর আয় করত। কিন্তু তাদের আয়ের পরিমাণ জানা সহজসাধ্য ছিল না। এ জন্য আমাকে সামাজিক জরিপের নিয়ম অনুযায়ী 'কি-ইনফরমেন্ট' নিয়োগ করতে হয়েছিল। বলা যায়, গবেষণার জন্য এক ধরনের গোয়েন্দাবৃত্তি করা। তবে গবেষণার নৈতিকতা রক্ষার জন্য কোনো তথ্যদাতার নাম প্রকাশ করা হতো না।