বৃষ্টি-ভেজা বিকেল। কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টিতে গাছগুলো স্নান করে নিয়ে গাঢ় সবুজ রং ধারণ করে তাকিয়ে আছে। পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের আলোতে পাতাগুলোকে মনে হচ্ছিল ইস্পাতের ধারালো তরবারি। তখনও বাতাসের খানিক তীব্রতা আছে। সেই বৃষ্টিভেজা ঠান্ডা বাতাস আমাদের যেন ভিন্ন কোথাও নিয়ে যাচ্ছিল।
ক্যাফের লবিতে গরম চা নিয়ে মুখোমুখি বসেছি সদ্য আফগানিস্তান থেকে আসা বন্ধু রোমেলের সঙ্গে। ছোট টেবিলের দু'পাশে দুজন। চা আর শিঙাড়া রাখার পর টেবিলে জায়গা নেই। ছোট ছোট টেবিলে এভাবেই আড্ডায় মেতেছে শ'খানেক মানুষ।
দুধের সর দিয়ে তৈরি মালাই চায়ে চুমুক দিতে দিতে শুনছিলাম রোমেলের কথা। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের কথা। মানুষের জীবন পাল্টে যাওয়ার কথা, সম্পর্ক পাল্টে যাওয়ার কথা, তাদের ব্রেইন পাল্টে যাওয়ার কথা। একটি সুন্দর জনপদ কীভাবে পাল্টে যেতে পারে সেই পরিবর্তনের কথা।
বিগত কয়েক বিলিয়ন বছরে এভাবেই হয়তো পাল্টে গেছে এই গ্রহের অনেক জনপদ, যার ইতিহাস আমরা জানি না।
রোমেল হঠাৎ কঠিন গলায় বললো, নড়িস না। তোর ডান দিকে ছয় ফুট দূরে একটা ড্রোন উড়ছে। ওর গানটা তোর দিকে তাক করা। আমি চাপা গলায় বললাম, হোয়াট? রোমেল বললো, ওরা সবসময় আমাকে ফলো করে। এখন এখানেও চলে এসেছে।
আমি স্ট্যাচু হয়ে গেলাম। কোনো রকমে শুধু ঠোঁট নেড়ে বললাম, ওরা এখানে কেন? কী চায়?
রোমেল আমার কথা সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলল, ওর কাছে ছোট নিডল-গান আছে। সুইয়ের মতো ছোট, বিষ লাগানো। ওটা কারও শরীরে লাগলেই সে মারা যাবে। মূলত এগুলো কিলিং-ড্রোন।
আমি চোখ পর্যন্ত বন্ধ করতে পারছি না। কান খাড়া করে শুনতে পেলাম, একটা হিসহিস শব্দ। আমার ঠিক কতটা দূরে সেটা বুঝতে পারলাম না। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছি রোমেলের দিকে। চারপাশের আর কেউ এই ড্রোন খেয়াল করেছে কিনা সেটাও বুঝতে পারছিলাম না। তবে টেবিলগুলোতে যতটা শব্দে আড্ডা হচ্ছিল, সেটা কমে এসেছে মনে হলো।
রোমেল ওর স্মার্টফোনটা হাতে নিয়ে কিছু টাইপ করছে। মুখে বলল, আমি একটু চেষ্টা করি। তুই চুপ করে থাক। কথা বলিস না।
আমি পাথর হয়েই আছি। দেড় মিনিটের মতো নেগোশিয়েট করল রোমেল। আমি তিনটি বিপ শব্দ শুনতে পেলাম। রোমেল বলল, বুঝতে পেরেছি। তুই এখন তাকাতে পারিস।
আমি ধীরে ধীরে ডান দিকে তাকিয়ে দেখি, গাছের ভেতর ছোট একটি ড্রোন উড়ছে। রোমেলকে জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কোথা থেকে আসে?
রোমেল বলল, জানি না। তবে ওগুলো সংখ্যায় অনেক। সারাক্ষণই আছে, কোথাও না কোথাও।
আমি আবারও প্রশ্ন করলাম, কে এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে?
রোমেল মুচকি হেসে বলল, সিস্টেম। ওরা নিজেরাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করে মনে হয়।
আমি বললাম, ওদের মালিক কে?
রোমেল বলল, সেটা তোকে বলা যাবে না। তাহলে তোর ক্ষতি হবে।
আমি বললাম, ঠিক আছে জানতে হবে না। সব জানা ভালো নয়।
২.
ওপরের কথাগুলো যদি আমি ২০ বছর আগে লিখতাম, তখন সবাই ভাবতেন আমি কল্পকাহিনি লিখছি। কাউকেই এটা বিশ্বাস করানো যেত না। কিন্তু বর্তমান সময়ে এর খুব কাছাকাছি বিষয়গুলো ঘটতে শুরু করেছে।
পৃথিবীর অনেক দেশই এখন যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোন ব্যবহার করতে শুরু করেছে। একটা সময় ছিল, যখন মানুষ মুখোমুখি যুদ্ধ করত। সরাসরি শরীরের শক্তি ব্যবহার করে তরবারি আর ঘোড়া দিয়ে যুদ্ধ। তারপর যখন কামান তৈরি হয়ে গেল, তখন দূর থেকেই কামান দিয়ে গোলা ছোড়া শুরু হলো। যার কাছে কামান নেই, তার হাজার হাজার ঘোড়া রেখে লাভ নেই। একটা কামানই তাদের ঠেকাতে যথেষ্ট।
কামান ট্যাঙ্ক এগুলোকেও সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে যেতে হয়। কিন্তু কিছু দেশ তখন আকাশের শক্তি বাড়িয়ে ফেলল। তারা ভূমি দিয়ে যেমন ট্যাঙ্ক চালাচ্ছে, আবার আকাশপথে ছোট ছোট প্লেনে করে বোমা ফেলছে। এর সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ দেখা গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে, তারপর আমেরিকার পার্ল হারবারে এবং শেষে জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার ব্যবহার। এর পরেও যুদ্ধ হয়েছে- মধ্যপ্রাচ্যে এবং নানান ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার দেখা গেছে।
সেই ধারাবাহিকতায় যুক্ত হয়েছে ড্রোন, মানুষবিহীন ড্রোন। ছোট একটি ড্রোন একা একাই উড়ে যাবে। সে সামনে গিয়ে আগে ভাগেই সবকিছু দেখে আসতে পারে। আবার সে চাইলে নিজের মতো বোমাও নিয়ে যেতে পারে; এবং জায়গা মতো ফেলে দিয়ে আসতে পারে। এবং যারা এই কাজটি করছে তারা থাকছে যুদ্ধের সীমানা থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে। আমেরিকার লাস ভেগাসে বসে আফগানিস্তানে বোমা মারা সম্ভব হয়েছে এই ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে।
বিষয়টি এখানেই থেমে থাকলে ভালো হতো। বিষয়টি আরও দূরে চলে গেছে। ড্রোন নিয়ে যেমন অনেক দেশই গবেষণা করছে, যা মিডিয়াতে আসছে না। তবে এখন পর্যন্ত যা খবর মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছে তার ভেতর সবচেয়ে এগিয়ে গেছে তুরস্ক। তুরস্ক এই প্রথম ড্রোন ছেড়েছে যার ভেতর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দেওয়া হয়েছে। এবং এই ড্রোনগুলো নিজের মতো উড়ে যেতে পারে, সঙ্গে করে অস্ত্র নিয়ে যেতে পারে এবং এগুলোর সঙ্গে ফেস-রিকগনিশন প্রযুক্তি রয়েছে। ফলে, আপনি যদি একজন ব্যক্তির ছবি দিয়ে ড্রোনটিকে পাঠিয়ে দেন, সে নিজে নিজেই ওই লোকটিকে খুঁজে বের করে মেরে আসতে পারবে।
যুদ্ধক্ষেত্রে এই ড্রোন খুবই কাজের। এরা নিজেরাই যে কোনো সৈন্যকে চিনতে পারবে এবং তাকে টার্গেট করে গুলি ছুড়তে পারবে। তুরস্ক ইতোমধ্যেই যুদ্ধক্ষেত্রে এই ড্রোন ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে সাফল্য পেয়েছে।
যুদ্ধের পাশাপাশি তথ্য সংগ্রহের জন্যও ড্রোন খুব জনপ্রিয় হচ্ছে। এবং পরের জেনারেশনের ড্রোনগুলো হবে আরও ছোট, ফাইভ-ডি/সিক্স-জি এনাবেল এবং আরও শক্তিশালী এবং সোলার পাওয়ার, যা উড়ন্ত রোবটের মতো কাজ করতে পারবে।
৩.
আমি ড্রোন প্রযুক্তি নিয়ে লিখতে বসিনি। ড্রোনকে ব্যবহার করেছি একটি উদাহরণ হিসেবে। এই গ্রহকে কীভাবে পাল্টে দিচ্ছে প্রযুক্তি সেটা দেখানোর জন্য। এমন আরও অসংখ্য প্রযুক্তিগত উন্নয়ন হচ্ছে এই বিশ্বে যা মানুষকে দ্রুতই পাল্টে দিচ্ছে। সেই পাল্টে যাওয়া বিশ্বে উন্নয়নশীল দেশগুলো কীভাবে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবে সেটাই মূল চিন্তার বিষয়।
আমরা যদি খুব বেশি অতীতে না যাই, তাহলেও দেখব- অটোম্যান সাম্রাজ্য বলি আর ফ্রান্সের লুইদের কথা বলি কিংবা আমাদের এদিকে মোগলদের কথা বলি, যত দিন গেছে দূরত্ব ক্রমে বেড়েছে। এমনকি ব্রিটিশদের শাসনামলে জাতিতে জাতিতে সক্ষমতার যে দূরত্ব ছিল, তা এখন অনেক বেশি।
বোঝার জন্য আরও কিছু ডাটা-পয়েন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন ধরুন এখন থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে ভারত বর্ষের সঙ্গে ইউরোপের যে সক্ষমতার দূরত্ব ছিল, কিংবা শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ফ্রান্সের সক্ষমতার ফারাক ছিল, সেটা বর্তমান সময়ে আগের তুলনায় অনেক বেশি ফারাক। ফ্রান্স এখন আরও বেশি শক্তিশালী এবং সক্ষম রাষ্ট্র। শ্রীলঙ্কা এখনও ক্যাচ-আপ করছে।
বাংলাদেশের বেলাতেও তাই। ১৯৭১ সাল থেকে বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়েছে। তার অনেক সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। এবং সেই সক্ষমতা যদি চীনের সঙ্গে তুলনা করা হয়, কিংবা সিঙ্গাপুরের সঙ্গে কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে, তাহলে দেখা যাবে সক্ষমতার মাপকাঠিতে তারা অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। ৫০ বছর আগে যে দূরত্ব ছিল, এখন সেটা আরও বেশি।
একইভাবে বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশগুলোর দিকে তাকালেও সেটাই দেখা যাবে। বিগত ৫০ বছরে সেই দেশগুলো যতটা এগিয়েছে, উন্নত বিশ্ব আরও অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। তাদের সক্ষমতা আরও বেশি তৈরি হয়েছে। খুব সহজভাবে যদি বলি, তাহলে তারা যে কার্ভের ওপর আছে, উন্নয়নশীল দেশগুলো ভিন্ন কার্ভের ওপর আছে। দুটি কার্ভ ভিন্ন। এবং কার্ভ দুটি ধীরে ধীরে আরও দূরে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ উন্নত বিশ্ব আরও বেশি সক্ষমতা তৈরি করছে, যা দিয়ে সে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর ওপর ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব বহাল রাখতে পারবে।
এর অন্যতম প্রধান একটি কারণ হলো প্রযুক্তি। সম্প্রতি সময়ে আমাজন এবং গুগল বাংলাদেশে ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন নিয়েছে। তাতেই আমরা কত খুশি। উপনিবেশবাদ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে একবার খেয়াল করেছেন? উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রতিদিন কী করে, কী দিয়ে ভাত খায়, কার সঙ্গে তার ওঠাবসা- এই সবকিছুই আমরা যতটা না জানি, তার চেয়ে অনেক বেশি জানে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন। আমাদের কার ব্যাংকে কত টাকা আছে, কার সক্ষমতা কেমন সেটা বাংলাদেশ ব্যাংক না জানলেও চীন বা আমেরিকা ঠিকই জানে। তার চেয়েও ভয়ংকর হলো, আমরা ঠিক জানিই না কী জানি না। কারণ, ওই দেয়ালের ওপারে তো আমাদের এক্সেস নেই। আমরা শুধু ওইটুকুই দেখতে পাই, যেটুকু আমাদের দেখতে দেওয়া হয়।
এই কারণেই উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সবসময়ই এটা হবে একটা 'ক্যাচ-আপ' গেম। এই গেম থেকে সে আর সহসাই বের হতে পারবে না। কারণ এই গেম থেকে বের হতে হলে তাকে অনেকটা মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে। আকাশে রকেট পাঠাতে গেলে যেমন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে জয় করতে হয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাউকে যদি উন্নত হতে হয়, তাকে সেই উন্নয়নের মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে জয় করে আসতে হবে। সেই শক্তির মূল উৎস কিন্তু খাদ্য, বস্ত্র, স্বাস্থ্য কিংবা বাসস্থান নয়; তার মূল উৎস হলো প্রযুক্তি। যে জাতির যত বেশি প্রযুক্তিগত সক্ষমতা থাকবে, তারাই এই ক্যাচ-আপ গেম থেকে বের হয়ে যেতে পারবে। আর যারা পারবে না, আগামী কয়েকশ বছর তাদের এই ক্যাচ-আপ গেমেই আটকে থাকতে হবে। এই জাতিগুলোরও উন্নয়ন হবে, তবে ততদিনে উন্নত বিশ্ব আরও অনেকদূর এগিয়ে যাবে। দূরত্ব বাড়তেই থাকবে।