পরাজিত দিল্লি সম্রাট বাহাদুর শাহকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন আশ্রয়দানকারী এক ফকির। ইংরেজ কর্মচারী হাডসন দিল্লির রাজপথে গুলি করে হত্যা করেন সম্রাটের পুত্রদের। তারপর লাশ টানিয়ে রাখেন চাঁদনিচকের উন্মুক্ত স্থানে। হুমায়ুন সমাধিতে প্রথম পালিয়েছিলেন সম্রাট। ভেবেছিলেন ফকির-মিসকিন আর দরবেশদের কাছে নিরাপদ থাকবেন। সবাই দিল্লির বাদশাহকে আগলে রাখবেন। কোনো সমস্যা হবে না। ইংরেজ সেনারাও টের পাবে না কিছুই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সরে পড়বেন। বাদশাহকে পরিবারসহ বিপদের দিনে এক মুসলমান ফকির আশ্রয় দিলেন। বাদশাহ কৃতজ্ঞতা জানানোর আগেই সেই ফকির বললেন, দিল্লির সম্রাটকে অতিথি করেছি আল্লাহপাকের ইচ্ছায়। না হলে এ সৌভাগ্যের অধিকারী কখনো হতে পারতাম না। আপনি আমাদের সঙ্গে থাকুন। কোনো সমস্যা নেই। নিজেকে নিরাপদ মনে করলেন বাহাদুর শাহ। কিন্তু না, কথা রাখলেন না ফকির। লোভে পড়ে সম্রাটকে ধরিয়ে দেন ইংরেজ সেনাদের হাতে। গ্রহণ করেন পুরস্কার। বিদায়ের সময় বাহাদুর শাহ হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে দেখলেন ফকিরকে। দুই চোখজুড়ে শুধুই বিস্ময়। বিশ্বাস আর আস্থার জায়গাগুলো এভাবে শেষ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সবারই আসা-যাওয়া ছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে। খুনি ডালিমকে কত দিন রান্না করে খাইয়েছিলেন। অদ্ভুত এক দুনিয়ায় বাস আমাদের। নিষ্ঠুরতার কারণে সমাজ-সংসারে আপন-পর চেনা যায় না। চারপাশের মানুষগুলো হুট করে বদলে যায়। মানুষই পারে গিরগিটির মতো নিজেদের বদলে ফেলতে। শেখ সাদি লিখেছেন, ‘হামা আজ দন্তে/গঁয়ের নলা কুনান্দ/সাদি আজ দন্তে/খেশতান ফরিয়াদ।’ অর্থাৎ ‘নিজের হাতই যখন নিজের গালে চড় বসিয়ে দেয়, তখন হে সাদি! অন্যের হাতে মার খাওয়া নিয়ে খেদ বা দুঃখ কী?’ বাহাদুর শাহ কোনো আফসোস করেননি আশ্রয়দানকারীর বিশ্বাসঘাতকতায়। বয়োবৃদ্ধ মানুষটি শুধু থমকে গিয়েছিলেন। বাহাদুর শাহকে ইংরেজ বেনিয়ারা নির্বাসনে পাঠায় রেঙ্গুনে। শেষ জীবনে নিঃসঙ্গ ছিলেন বাদশাহ। সময় কাটাতেন কবিতা লিখে। নিজের অসহায়ত্বের কথাই বেরিয়ে আসত সে কবিতায়। ভাগ্যবান মানুষ আমি। বাহাদুর শাহের মাজার জিয়ারতের সুযোগ পেয়েছিলাম। ইয়াঙ্গুনে বাহাদুর শাহের মাজার জিয়ারতের সময় বলেছিলাম, ‘হে আল্লাহ! এই মানুষটি দিল্লির সম্রাট ছিলেন। দুনিয়ার এই বাদশাহর শেষ জীবনটা ছিল কষ্টের। দুঃসময়ে আশ্রয়দানকারীর বিশ্বাসঘাতকতায় সন্তানদের হারিয়ে নির্বাসনের জীবন কাটাতে হয়েছিল বাদশাহকে। আপনি ভারতবর্ষের শেষ বাদশাহকে হেফাজতে রাখুন।’