এক ঋতু থেকে আরেক ঋতু। এক মাস থেকে আরেক মাস। সময়ের পালাবদলের সন্ধিক্ষণটি খুবই জরুরি। এ সময় প্রকৃতিতে থাকে নানা নির্দেশনা। প্রকৃতির এ নির্দেশনাগুলো মেনেই নানা সমাজে নানা ভূগোলে দিনযাপনের নানা কৃত্য। নানা পরব, নানা আয়োজন। মাসের শেষ দিনটি সংক্রান্তি এবং প্রথম দিনটি ‘মাস পয়লা’ হিসেবেই পালিত হয় গ্রামীণ জনপদে। মাস বা বছরের প্রথম দিন নয়, গ্রামীণ নিম্নবর্গ গুরুত্ব দেয় মাসের শেষ দিন, ঋতুর সন্ধিক্ষণকে। এটি বদলে যাওয়ার ক্রান্তিকাল। আর তাই ঐতিহাসিকভাবেই বাংলা মাসের শেষ দিনগুলো সংক্রান্তির দিন হিসেবে নানা আয়োজন ও কৃত্যে মুখর হয়ে ওঠে। বৈশাখে ভাটিপরব, জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে কর্মাদি, শ্রাবণে করন্ডি, ভাদ্রে কারাম, আশ্বিনে দাসাই, কার্তিকে জালাবর্ত, অগ্রহায়ণে ওয়ান্না, পৌষে পুষরা, মাঘে বাঘাই শিরনি, ফাল্গুনে ঘাটাবান্ধা আর চৈত্রে চইতপরব বা চৈত্রসংক্রান্তি। এক এক ঋতুতে প্রকৃতি নানা প্রাণের ভেতর দিয়ে তার সমাপনী ও শুরুর নির্দেশনা জানায়। প্রকৃতির নয়া শস্য ফসল গ্রহণ ও ব্যবহারের জন্য অনুমতি প্রার্থনা ও আশীর্বাদের তরে নানা সমাজ আয়োজন করে নানা কৃত্য। ফাল্গুনে ভাঁট, শাল, মহুয়া, মিষ্টিকুমড়ো, বিলিম্বি, ভেন্না, আমরুল, নাগেশ্বর, পলাশ, কাঁঠালিচাঁপা, দোলনচাঁপা ও কনকচাঁপা ফোটে। প্রকৃতি জানান দেয় বসন্ত ঋতু এসেছে। সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে এ সময় ভাঁট ফুল দিয়ে ঘাটাবান্ধা বর্ত করা হয়, গোপালগঞ্জের চলনবিলে মিষ্টিকুমড়োর ফুল দিয়ে শিশুরা হেঁচড়া পূজা করে, আর সাঁওতাল সমাজ শাল-মহুয়ার ফুলে আয়োজন করে বাহা। চৈত্র দিনে মাটি রুক্ষ হয়, কালবৈশাখী ছোটে। শিলাবৃষ্টি থেকে ধানের জমিন রক্ষায় শিরালেরা রাত-দিন মন্ত্র জপে হাওরাঞ্চলে। চৈত্রের শেষ দিন বা সংক্রান্তি বাঙালি কি আদিবাসী দেশের গ্রামীণ নিম্নবর্গের জীবনে এক গুরুত্ববহ আখ্যান। চারপাশের প্রকৃতির নির্দেশনায়ই এ আখ্যান গড়ে উঠেছে। সুন্দরবন অঞ্চলে বাঙালি সনাতন হিন্দুদের ভেতর চৈত্রসংক্রান্তির দিন মাটি দেয়ে কুমিরের প্রতিকৃতি বানিয়ে দেলপূজা করা হয়। বরেন্দ্রভূমিতে চৈত্রসংক্রান্তিতে কুমির বানানোর চল নেই। সুন্দরবন অঞ্চলে কুমির আছে বলেই হয়তো তা কৃত্যের আরাধ্য হয়েছে।