‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কুইজ’ অনেকগুলো বিষয়ে আমার চোখ নতুন করে খুলে দিয়েছে। বর্তমান সময়ের মানুষের পড়ার প্রতি মনোযোগ কমে গেছে, সেটা জানি। তার চারপাশে এত বেশি ভিজ্যুয়াল বিষয় চলে এসেছে যে পড়ার চেয়ে দেখার পরিমাণ বেড়ে গেছে মাত্রাতিরিক্ত। মানুষের ব্রেইন সহজ বিষয়ের দিকে বেশি ধাবিত হয়। এভাবেই আমাদের ব্রেইন তৈরি করা। পড়তে কষ্ট বেশি এবং ফলাফলও বেশি। পড়ার অভ্যাস মানুষকে অনেক বেশি ক্রিয়েটিভ এবং ফোকাস করতে শেখায়।
পড়ার জন্য মানুষের ব্রেইনের যে অংশ অ্যাকটিভ থাকে, দেখার জন্য থাকে ভিন্ন চেম্বার। টিভি দেখতে যত আরাম, বই পড়তে কিন্তু তত আরাম না (যদি না আপনি সত্যি সেই লেখার সঙ্গে নিজেকে কানেক্ট করতে পারেন)। ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন এত কিছু দেখার আছে, কিংবা শোনার আছে, সেখানে হেডলাইন পড়ার সময়ই তো আমাদের নেই! তার ভেতর গিয়ে বিষয়বস্তু খুঁজে পড়া এবং তার থেকে রস বের করার মানুষের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। তাই লেখালেখির মাধ্যমটি বেশ ঝুঁকির মুখে পড়েছে। সেটা গল্প, কবিতা কিংবা রিপোর্টিং– যা-ই হোক।
এই দেশে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করলেও কিছু হয় না, সেখানে লিখে কিছু হতে পারে- সেটা আমার মনে হয় না। বিশেষ কিছু মানুষ লেখা পড়ে, বাকিরা টাইটেল পড়াতেই সীমাবদ্ধ। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ তৈরি হতে হলে, একটা ভালো রিপোর্ট কিংবা সম্পাদকীয় অনেক কিছু পাল্টে দিতে পারে। বাংলাদেশকে সেই জায়গায় যেতে আরও অনেকটা পথ হাঁটতে হবে।
বাংলাদেশের বয়স পঞ্চাশে এসে পড়ল। এবং এখনো এই ইন্টারনেটের মান নিয়ে লিখছি, ভাবতেই শরীর অলস হয়ে পড়ছে। স্রষ্টা তো আমাকে এত ধৈর্য দিয়ে পাঠাননি। একই কথা কত আর বলা যায়!
২.
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কুইজ করতে গিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে দেখেছি, ঢাকার বাইরে ইন্টারনেটের কোয়ালিটি ভালো নয়। যদিও টেলিফোন কোম্পানিগুলো দাবি করে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে থ্রি-জি কিংবা ফোর-জি আছে, কিন্তু তাদের মান খুব খারাপ। কারো সঙ্গে কয়েক মিনিটের বেশি ভিডিও কল করা যায় না। আর গ্রুপ ভিডিও কলের অবস্থা তো আরও জঘন্য। ইন্টারনেটের কোয়ালিটি বুঝতে হলে সেখানে দেখতে হবে- রিয়েল টাইম কমিউনিকেশন কোথায় ভালো। ইন্টারনেটের ওপর দিয়ে ভয়েস কিংবা ভিডিও কল হলো রিয়েল টাইম কমিউনিকেশন। বাংলাদেশে মোবাইল ডেটায় এটা মোটেও ভালো নয়। কয়েক মিনিটও স্থিতিশীল থাকে না।
ঢাকা থেকে কুড়িগ্রামে ভিডিও কনফারেন্সিং করবেন? সিলেট? কক্সবাজার? সাতক্ষীরা? দেশের যেদিকেই যান না কেন, অবস্থা ভালো নয়। কথা কেটে যাবে, নয়তো ভিডিও চলবে না।
জিএসএম ভয়েস সেবা ভালো, সেটা বলতে হবে। কিন্তু ইন্টারনেটের ওপর দিয়ে যোগাযোগব্যবস্থা তথৈবচ। এর জন্য পুরোপুরি দায়ী মোবাইল ফোন সেবা প্রদানকারী কোম্পানিগুলো।
আমাদের গ্রাহকরা এতটাই ভদ্র যে, তারাও এটাকে মেনে নিয়েছে। কোভিড এসে আরেকটা অজুহাত পাওয়া গেছে। কিছু বললেই তারা বলে, কোভিডের জন্য গ্রাহকের চাপ বেড়ে গেছে, তাই মান কমে গেছে।
বাংলাদেশের গ্রাহকরা আসলেই ভালো। তারা কিছুই বলে না। তারা হয়তো ভাবছে, এটুকু পাচ্ছি, সেটাই তো অনেক। আগে তো সেটাও ছিল না। কিন্তু তারা তাদের অধিকার সম্পর্কে জানেই না। তাদের ইন্টারনেট পাওয়ার যে একটা অধিকার আছে, এটা নিয়ে তাদের জ্ঞান নেই।
ভৌগোলিক আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশ খুবই ছোট, মাত্র ৫৫ হাজার বর্গমাইল। এই পরিমাণ জায়গাকে ভালো মানের ইন্টারনেট সংযোগ দিতে বিনিয়োগের পরিমাণ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম লাগে। বাংলাদেশে যেই প্রতিষ্ঠানগুলো মোবাইল সেবা দিয়ে থাকে, তারা এশিয়ার অন্যান্য দেশেও একই সেবা দিয়ে থাকে। কিন্তু সেই সব দেশের তাদের সেবার মান কিন্তু অনেক ভালো। যারা বিদেশে যান, তারা নিশ্চয়ই বিষয়টি জানেন। ধরা খেয়ে বসে আছে আমাদের ভদ্র গ্রাহকরা।
৩.
আমাদের দেশে টেলিকম সেবা এসেছে ২০ বছরের বেশি। এবং আমাদের গ্রামের মানুষ ইন্টারনেট পাচ্ছে, তাতেই আমরা খুশি! আমরা ভুলেই গেছি, আমাদের কী পাওয়ার কথা ছিল- আর আমাদের দেয়া হচ্ছেটা কী!
বাংলাদেশে সরকার টেলিফোন কোম্পানিগুলোকে দেশের সম্পদ দিয়েছে আমাদের ভালো সেবা দেয়ার জন্য। সেই সম্পদের একটি বড় সম্পদ হলো ফ্রিকোয়েন্সি বা তরঙ্গ। এই তরঙ্গ এই দেশের সম্পদ, যা ব্যবহার করে মোবাইল কোম্পানিগুলো সেবা প্রদান করছে এবং ব্যবসা করছে। এই সম্পদ না পেলে তারা এই ব্যবসা করতে পারত না।
এই তরঙ্গ দেয়ার সময় তাকে কিছু শর্ত দিয়ে দেয়া হয়েছিল। তার একটি শর্ত হলো ‘কোয়ালিটি অব সার্ভিস’ (সংক্ষেপে কিউওএস)। এই কোয়ালিটি অব সার্ভিসে বলা আছে, তাকে ভূখণ্ডের কত অংশ সেই তরঙ্গের আওতায় আনতে হবে এবং কত মানের ভয়েস এবং ইন্টারনেট সেবা তাকে দিতে হবে। এবং সেই শর্তগুলো সবগুলোই আন্তর্জাতিক মানের। অর্থাৎ সিঙ্গাপুরে যা, ব্যাংককে যা- বাংলাদেশেও তাই। সেই শর্তে বলা হয়নি যে, বাংলাদেশের মানুষকে তুমি কোনোরকমে ইন্টারনেট সেবা দেবে। তাকে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে, তুমি এই অঞ্চলের সব গ্রাহককে সমানভাবে সেবা দেবে- এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও।
টেলিকম কোম্পানিগুলো করেছে কী জানেন? তারা ঢাকা শহরে বেশি বিনিয়োগ করে, পুরো দেশটাতে আর সেটা করেনি। সেখানে তারা কোনোরকমে চলে, এইভাবে বিনিয়োগ করেছে। গ্রাহকের কাছে ব্যবসা হলে তারা ওইসব জায়গায় মান বাড়াবে। এটা ঠিক, মান বাড়াতে তাদের বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু সেই বিনিয়োগটা তারা করেনি। তারা বেছে বেছে বিনিয়োগ করেছে। আগে সেটা খুব একটা টের পাওয়া যেত না, কারণ প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষ ততটা ইন্টারনেট ব্যবহার করত না। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা গ্রামে চলে গেছে। আর আমরাও সারা দেশে এই কুইজ করতে গিয়ে দেখলাম, সেই গ্রামের মানুষটির ইন্টারনেটের মান ভালো নয়। দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।
এর অর্থ দাঁড়ায়, তারা কোয়ালিটি অব সার্ভিসে যা বলা ছিল, সেটা মানছে না। লাইসেন্সে বলা রয়েছে, কোয়ালিটি অব সার্ভিস ঠিক না থাকলে তাকে জরিমানা করা যাবে। গত ২০ বছরে কখনো সেটা প্রয়োগ করা হয়েছে বলে শুনিনি।
তবে সম্প্রতি বিটিআরসি একটি ভালো পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা এই ‘কোয়ালিটি অব সার্ভিস’ পরিমাপ করার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরীক্ষা করা শুরু করেছে। সেই কাজ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত চলবে। পুরো ভূখণ্ড ধরে পরীক্ষা করা হবে- কোথায় কেমন সেবা মানুষ পাচ্ছে। সেই রিপোর্টগুলো প্রকাশিত হলে, আমরা কাগজে-কলমে বুঝতে পারব কোথায় কেমন নেটওয়ার্ক বসিয়েছে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো। আশা করছি, বিটিআরসি সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে কিছু ব্যবস্থা নেবে।
তবে, এর পাশাপাশিও সাধারণ ব্যবহারকারীদের অংশগ্রহণটাও জরুরি। গ্রাহক যত বেশি সচেতন হবে, প্রতিষ্ঠানগুলো তত বেশি ভালো সেবা দিতে বাধ্য থাকবে। এটা তো দয়া নয়, অধিকার। সেই অধিকার আদায়ে তাদেরও সোচ্চার হতে হবে। এর একটি ভালো কাজ হতে পারে ভোক্তা অধিকারে গিয়ে মামলা করা। যদি লাখ লাখ গ্রাহক সেখানে গিয়ে মামলা করে, তাহলে একটা প্রেশার তৈরি হতে পারে। তা না হলে এই বিপুলসংখ্যক গ্রাহক- তাদের এখন যা দেয়া হচ্ছে, সেই মান নিয়েই তাদের থাকতে হবে।
ফেব্রুয়ারি মাস শুরু হয়েছে। এবারে বইমেলা শুরু হলো না বলে খুব একটা টের পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু এটা তো সত্যি যে, বাংলা ভাষার অধিকারের জন্য মানুষকে জীবন দিতে হয়েছিল, যা আমাদের জাতীয় জীবনের অংশ হয়ে গেছে। আমাদের প্রাণের সঙ্গে মিশে আছে। একই পথে এই শতাব্দীর মানুষের তো আধুনিক সুবিধার জন্য সোচ্চার হওয়ার কথা। তারা সেই অধিকারের জন্য সোচ্চার হয় না কেন?