১ ডিসেম্বর ২০২০ থেকে সারা দেশে শুরু হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কুইজ (https://quiz.priyo.com)। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন এবং কর্মকে তরুণ সমাজের কাছে তুলে ধরার জন্যই অনলাইনে মূলত ১০০ দিনের এই কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি। আর সার্বিক সহায়তায় রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। এর স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হিসেবে রয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ। বাস্তবায়ন সহযোগী হিসেবে রয়েছে প্রিয় ডটকম।
কুইজটির ধারণা এবং বাস্তবায়নের সঙ্গে যেহেতু আমি সরাসরি যুক্ত রয়েছি, তাই কয়েকটি বিষয় এখানে লিখে রাখাটা জরুরি। তাতে আমার মাথায় যা আছে, সেটা কোথাও লিপিবদ্ধ হয়ে থাকল। প্রথমেই বলে রাখি, এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কুইজ প্রতিযোগিতা; এবং এর জন্য রাষ্ট্রীয় কোনো অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত এর ব্যয় বহন করছে দারাজ এবং টেলিটক। আরো দু-তিনটি প্রতিষ্ঠান এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। এখনো এর প্রচার তেমন শুরু হয়নি। তবু ইতোমধ্যেই প্রথম দিনে এতে অংশ নিয়েছেন ৩৯,৬৮৮ জন, দ্বিতীয় দিন ৬৫,৮৯৩ জন এবং তৃতীয় দিন ৭৭,৬৬১ জন। আমি আশা করছি, আগামী ১০০ দিনে এই সংখ্যাটি আরো অনেক বাড়বে।
এই কুইজটির ধারণা যখন আমি প্রস্তাব করি, তখন মূলত তিনটি বিষয় আমাকে ড্রাইভ করেছে। এবং এই তিনটি বিষয়ে আপনার সচেতনতা থাকলে, আপনি এই কুইজটিতে অংশ নিতে পারেন এবং আপনার আশপাশের মানুষকে জানাতে পারেন।
এক : ফ্যাক্টস
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রচুর বই রয়েছে, প্রচুর প্রকাশনা রয়েছে, প্রচুর তথ্য রয়েছে। ইন্টারনেটেও অনেক তথ্য আজকাল পাওয়া যায়। কিন্তু এই বিষয়ে লেখাপড়া করতে গিয়ে দেখি, অসংখ্য ভুল তথ্য দিয়ে বই ছাপানো হয়েছে। এবং সেই বইগুলো বাজারে তো বটেই, একুশে বই মেলাতেও পাওয়া যায়। এবং অসংখ্য বই বিখ্যাত লেখকদেরও লেখা।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি, এটা কীভাবে সম্ভব? খুবই বিখ্যাত লেখক, প্রকাশনীও বিখ্যাত- বইতে তথ্য মারাত্মক রকমের ভুল। আবার অনেক বই কপি/পেস্ট করে ছাপানো। এক জায়গার ভুল আরেক জায়গায় হুবহু চলে গিয়েছে।
পৃথিবীর বিখ্যাত মানুষদের নিয়ে নানান রকমের গল্প থাকে, মিথ থাকে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সময় তো পাল্টে গেছে। গত পঞ্চাশ বছরে অনেকটা পথ হেঁটেছে এই গ্রহ। আর গত ১০ বছরে তো বটেই। এখন সঠিক তথ্য ছাড়া, ফ্যাক্টস ছাড়া কিছু চালানো প্রায় অসম্ভব। বিশেষ করে ইন্টারনেটের যুগে, মানুষ দিনকে দিন আরো ফ্যাক্টসনির্ভর হচ্ছে। যদিও ফেসবুককে আমরা ফেক নিউজের আখড়া বলছি, কিন্তু সেটা সাময়িক। আধুনিক প্রযুক্তি এমন জায়গায় চলে যাচ্ছে, কিছুদিনের মধ্যেই রোবট এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলে দিতে পারবে, কোনটা ফেক আর কোনটা সঠিক।
এই কয়েক বছর আগেও আমরা একটি গ্রুপ ছবিতে কে কে আছে, কম্পিউটার বলতে পারত না। এখন খুব দ্রুত গতিতে প্রায় নির্ভুল ট্যাগ করতে পারে। এই ধরনের আরো অনেক নতুন প্রযুক্তি চলে আসবে, যখন আপনি চাইলেও ফেক নিউজ প্রচার করতে পারবেন না। এমনকি একটি গালি দিলেও আপনি ফিল্টার আউট হয়ে যেতে পারেন। সেই দিকেই যাচ্ছে পৃথিবী।
আমাদের অনেক বিখ্যাত লেখকরা মনের মাধুরী মিশিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন রকমের লেখা লিখে গেছেন। তার অনেক কিছুই কল্পনাপ্রসূত। আবার অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে অতিমানব বানাতে গিয়ে অতিরিক্ত বিষয় নিয়ে এসেছেন। আর অপপ্রচারের কথা নাইবা বললাম। এই টানাটানির ভেতর আসল সেই মানুষটিকে নতুন প্রজন্ম কীভাবে জানবে? আমরা চাই বা না চাই, পরের প্রজন্ম তথ্যনির্ভর হবেই। এ ছাড়া তাদের কোনো উপায়ও নেই। আগামী ১০ বছরে পৃথিবী যেভাবে পাল্টে যাবে, আপনি যদি তথ্যনির্ভর না হোন, ডেটা ড্রিভেন না হোন, আপনি ছিটকে পড়বেন। দেখবেন, গুগলই আপনার সার্চে ওই পোস্টগুলো ফিল্টার করে দিচ্ছে। আপনি শত চেষ্টা করেও সেই পেজগুলোকে সামনে আনতে পারবেন না।
এই কুইজের প্রথম শর্তই হলো ফ্যাক্টস। আপনি যদি তথ্যনির্ভর মানুষ হোন, তাহলে এর ওপর চোখ রাখুন।
দুই: ন্যাশনাল প্রাইড
বাংলাদেশের ১০ কোটির বেশি মানুষের বয়স ৩০-এর নিচে। আমাকে কেউ বলতে পারেন, এই বিশাল তরুণসমাজের কাছে তাদের ‘ন্যাশনাল প্রাইড’-টা কী? আমি সিরিয়াসলি জানতে চাই। এই দেশের ১৬-১৮ কোটি মানুষের ন্যাশনাল প্রাইড কি? তরুণরা এবং পরের প্রজন্ম কী নিয়ে গর্ববোধ করবে? কিংবা এখন করে?
আমি চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই, কোটি কোটি তরুণ মানুষ পঙ্গপালের মতো ছুটছে। এই যে বিশাল একটি নব্য মানব গোষ্ঠী, তারা আসলে কী নিয়ে গর্ব করে? মুক্তিযুদ্ধ? জাতীয় নেতা? বিজ্ঞানী? আন্তর্জাতিক মানের লেখক? উদ্ভাবনী? কিংবা তারা আদৌ কী কোনো কিছু নিয়ে গর্ব করে? নাকি, তাদের মনস্তত্ত্ব ভিন্ন? তারা কোনো দেশ-কাল মানে না, কোনো বর্ডার মানে না। তারা গর্ব কী বিষয়ে, সেটা ধরতেই পারে না? কোনটা সত্যি?
একটি দেশ আগামী বছর ৫০-এ পা দেবে। বুদ্ধিজীবীদের কথা শুনলে মনে হবে, আমাদের গর্ব করার অনেক কিছু আছে। কিন্তু কেউ কি একটু সার্ভে করে দেখেছেন, তরুণরা আসলেই কী নিয়ে গর্ব করে? তাদের একটি বিশাল অংশ চাকরির বাজারে হিমশিম খাচ্ছে, আর কেউ কেউ ফ্রিল্যান্সার হয়ে দেশে বসে বিদেশের কাজ করছে? এবং বয়সে যারা আরো তরুণ, এখনো চাকরির বাজারে আসেনি, এখনো শিক্ষার্থী- তাদের কাছে জাতীয় গৌরবের বিষয়গুলো কী কী?
তারা হয়তো মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে গর্ব করে, জাতির পিতাকে নিয়ে গর্ব করে, চার নেতাকে নিয়ে গর্ব করে, সবুজ বাংলাদেশ নিয়ে গর্ব করে, সেনাবাহিনীকে নিয়ে গর্ব করে, বাঙালির আতিথেয়তা নিয়ে গর্ব করে, খাবার নিয়ে গর্ব করে, সততা নিয়ে গর্ব করে, পোশাকশিল্পকে নিয়ে গর্ব করে- এমন অনেক কিছু আমরা লিখতে পারি। কিন্তু আসলেই সে কী নিয়ে গর্ব করে, সেটা কি কেউ জানেন? সত্যি জানেন?
আমার কাছে মনে হয়, আমরা একটা আত্মবিধ্বংষী জাতি। আমরা আমাদের জাতীয় গৌরবগুলোকে নষ্ট করার জন্য যাবতীয় কাজ করেছি। আজকের তরুণ ছেলে বা মেয়েটি, সে কি আসলেই মুক্তিযুদ্ধকে জানে? শেখ মুজিবকে জানে? একটি মানুষ কী সাংঘাতিক ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন- সেটা কি আসলেই এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা জানে? আমরা কি তার ছিটেফোঁটাও এখন করি? কেউ কি করে?
আমাদের এই পরের প্রজন্মকে যদি বিশ্বের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে টেক্কা দিতে হয়, তাহলে তাকে তার ন্যাশনাল প্রাইড কী- সেটা জানতে হবে। নইলে সে কখনোই অন্যদের সঙ্গে পেরে উঠবে না। যারা দেশ ত্যাগ করে বিদেশে চলে যাবে- তারা বাংলাদেশি বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পাবে। আর যারা দেশে থাকবেন, তারা বুঝতেই পারবেন না- অন্য দেশের মানুষ তাকে কীভাবে মূল্যায়ন করছে। এটা বোঝার জন্য আত্মসন্মান লাগে। আর ন্যাশনাল প্রাইড ছাড়া কারো ভেতর আত্মসন্মান তৈরি হওয়ার আর কোনো রাস্তা তো নেই।
আজ যারা উন্নত তাদের দিকে তাকিয়ে দেখুন- তাদের সবার ন্যাশনাল প্রাইড আছে। তারা সেটাকে নিয়ে গর্ব করে। ভেতরে লালন করে। সেটাকে বাঁচিয়ে রাখে। পরের প্রজন্মের কাছে আবার সেটা দিয়ে যায়। আমরা কি সেটা পেরেছি?
বঙ্গবন্ধু আমাদের ন্যাশনাল প্রাইড। তরুণদের সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। এবং সেটা ডিজিটাল ফরম্যাটেই বেশি সম্ভব।
তিন: গ্লোবাল ট্রেকিং
আপনারা নিশ্চই জানেন, আমরা একটি গ্লোবাল ট্রেকিংয়ের ভেতর পড়ে গেছি। এই গত শতাব্দীতেও অনেক কিছু ছিল লোকালাইজড। স্থানীয়ভাবে কিছু করলে তার প্রভাব বাইরে যেত না। আপনি চট্টগ্রামে বসে কী করছেন, সেটা ঢাকার মানুষ ততটা জানত না। ১০০ বছর আগে তো এক গ্রামে কিছু ঘটলে পাশের গ্রামের মানুষ কিছু জানত না। কিন্তু এখন কি তেমন আছে? আরো ১০ থেকে ২০ বছর পর কী হবে?
আমরা সজ্ঞানে এমন একটি ট্রেকিংয়ের ভেতর পড়ে গেছি, যা আমাদের দেশের মানুষ জানে না, কিন্তু বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো জানে। আপনি কোথায় থাকেন, কী করেন, কোথায় কাজ করেন, কার সঙ্গে প্রেম করেন, আগামী দিনের পরিকল্পনা কী- সবকিছুই এখন জানে ফেসবুক, গুগল, অ্যাপল এবং আমাজন। আপনার ব্যক্তিগত তথ্যগুলো কিন্তু দেশের সরকারও এত বিস্তারিত জানে না। তারা হয়তো বিশেষ কিছু মানুষের তথ্য জানে। কিন্তু ওই বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো তো আপনার সবই জানে। এমনকি কে কাকে ধর্ষণ করছে, সেটা পুলিশ টের পাওয়ার আগে তারা টের পায়! ভয়াবহতাটুকু কেউ টের পাচ্ছেন? আমরা কীভাবে কিছু প্রতিষ্ঠানের নজরদারিতে চলে এসেছি, যা ১০ বছর আগেও ছিল না। আমরা এটা নিয়ে খুব যে চিন্তিত, তা-ও নই কিন্তু! আমরা খুশি হয়েই তাদের এইসব জানাচ্ছি। আপনি এখন চান বা না চান, বৈশ্বিক নজরদারিতে আপনি পড়ে গেছেন।
এর অর্থ হলো, আমাদের মানুষগুলো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কী করছে, নিজেকে কীভাবে প্রকাশ করছে- সেই বিষয়গুলো গ্লোবালি পরিমাপ করা হচ্ছে। আমাদের এখন ৩ কোটির বেশি মানুষ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছেন। তারা আমাদের পতাকা বহন করছেন। তারা বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরছেন। তাদের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশ সম্পর্কে পৃথিবীর মধ্যে ব্র্যান্ড তৈরি হচ্ছে। সেই ব্র্যান্ডটা আমাদের কেমন?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (বিশেষ করে ফেসবুক এবং ইউটিউব) আমাদের যে বিশাল জনগোষ্ঠী প্রতিদিন নিজেকে প্রকাশ করছে, তাদের মানটা কি কেউ দেখেছেন? তাদের সংখ্যাটা অনেক বড়, এবং তারা ডিজিটাল মাধ্যমের কারণে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে এক্সপোজ করছেন। সেই প্রকাশগুলো গ্লোবাল মাপকাঠিতে খুব সুবিধাজনক জায়গায় নয়।
এই বিশাল জনগোষ্ঠীর রুচিটা যদি একটুখানি ওপরের দিকে ঠেলে দেয়া যায়, তাহলে কিন্তু বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং আরো অনেক ভালো হতে পারে। সেই কারণে তাদের নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। আমি একা একা ভালো থাকব, সেটা একধরনের চিন্তা। আর আপনি যদি দেশের কথা ভাবেন, তাহলে তাদের নিয়েই আপনাকে সামনে এগোতে হবে। আমরা যত বেশি রুচিশীল মানুষ তৈরি করতে পারব, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তত বেশি পরিচ্ছন্ন হবে। এই সংখ্যা আমাদের বাড়াতে হবে।
আর সে কারণেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতিবাচক বিষয়গুলোকে তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। বিভিন্ন রকমের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাদের রুচিকে উন্নত করতে হবে। তারা যেন যে কারো পোস্টের নিচে গিয়ে একটি খারাপ ভাষা ব্যবহার করে গালি দিয়ে ফেলতে না পারে। সেই গালিটা দেয়ার আগে যেন একটু ভাবে, তার নিজের সন্মান সে নিজেই হারাচ্ছে। এটা তখনই হবে, যখন তার ভেতর সন্মানবোধ তৈরি হবে; তার রুচি উন্নত হবে।
চলুন, আমরা সবাই মিলে রুচিশীল মানুষের সংখ্যাটা আরেকটু বাড়িয়ে ফেলি!