‘সেক্সি’ শব্দটা বাংলাদেশে একটি নেতিবাচক শব্দ। আপনি যদি কোনো নারীকে বলেন, তোমাকে বেশ সেক্সি লাগছে - তাহলে আপনি ক্ষেত্রবিশেষে চড়-থাপ্পড় খেতে পারেন। নয়তো যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে পারে। খুব কম ক্ষেত্রেই আপনার মেসেজটা অপর পাশের মানুষটি বুঝতে পারবে। আবার উল্টোটাও সত্যি। কেউ কেউ হয়তো ‘সেক্সি’ শব্দটাই কেবল জানে। কারো সঙ্গে ভিন্ন রকমের সম্পর্ক তৈরি করতে গিয়ে বলে ফেলল কথাটি; আর মনে মনে আশা করে থাকল- এই বুঝি মেয়েটি তার সঙ্গে বিছানায় যাবে। তার জন্য চড় তো প্রাপ্যই বটে।
সেক্সি শব্দটার বাংলায় লেখা হয় ‘যৌনাবেদনময়ী’। এটা মুখে বলা হয় না বাংলাদেশে। এত লম্বা শব্দ বলতে কষ্ট অনেক। কিংবা বলতে আমরা লজ্জা পাই। তবে পত্রিকায় শিরোনাম থাকে প্রচুর। এবং সঙ্গে যারপরনাই ছবি ছাপিয়ে দেয়া হয়। এটা নিয়ে লেখা কিংবা আলোচনা করা খুবই নাজুক। আমাদের কাছে এগুলো টাবু হয়ে বেঁচে আছে।
আপনি যদি শাব্দিক অর্থ দিয়ে বিচার করেন, তাহলে সেক্সি অর্থ অবশ্যই ‘যৌন আবেদনময়ী’। কিন্তু এটার একটা ইনফরমাল অর্থ আছে, যা প্রচলিত ভাষায় ব্যবহার করা হয়। বিশ্বের অনেক ভাষায় এটা জনসমক্ষেও বলা হয়। এমনকি টিভি এবং জাতীয় গণমাধ্যমেও শব্দটি ব্যবহার করা হয়। কাউকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই তোমার নতুন চাকরিটা কেমন লাগছে?’ সে উত্তরে বলতে পারে, ‘নাহ, এটা তেমন সেক্সি না!’ কিংবা আপনি আপনার পরিচিত কোনো নারীকে যদি বলেন, ‘এই তোমাকে আজকে খুব সেক্সি লাগছে’- সে হয়তো মুচকি হেসে বলবে, ‘ওহ তাই নাকি; অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।’ এমনো হতে পারে, সে করিডর দিয়ে কয়েক পা হেঁটে গিয়ে হারিয়ে যাওয়ার আগে আবার মাথা ঘুরিয়ে আপনার দিকে আরেকবার মুচকি হাসতে পারে! ওই হাসি দেখে কারো বুক কেঁপে উঠতে পারে। কিন্তু মেয়েটি ভদ্রতা করে আপনার প্রতি সৌজন্যতা দেখিয়েছে। ব্রিটিশ সুন্দরী মেয়েরা আরো মজার কিছু করতে পারে। তাদের সেন্স অব হিউমার অনেক বেশি।
বাংলাদেশে ‘মেধা’ শব্দটার হয়েছে এই পরিণতি। পুরো পৃথিবীতে মেধা বা ট্যালেন্ট বললেই মানুষ বুঝতে পারে - এটা একটি ইতিবাচক শব্দ। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রশ্ন- চোরেরও তো মেধা আছে; তাহলে কেমনে কী!
আমার আগের লেখায় যখন বলতে চাইলাম, আমাদের মেধা লাগবে- সঙ্গে সঙ্গেই অসংখ্য মানুষ বলতে লাগলেন, শুধু মেধা দিয়ে হবে না, সঙ্গে সততাও লাগবে।
কিন্তু তারা বুঝতে পারছেন না, মেধা শব্দটা একটি ইতিবাচক শব্দ। চোর-ডাকাতের জন্য এই শব্দটি নয়। এই শব্দটি ব্যবহার করা হয় উঁচু স্তরের মানুষের জন্য, যাদের ব্রেইন ভিন্নভাবে কাজ করে- যাদের কোনো সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা থাকে, তাদের জন্য। মেধাবী বললেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে কিছু চকচক করা চোখ, যারা জটিল সমস্যার সমাধান বের করে ফেলতে পারেন- এই মানবসভ্যতাকে আরেকটু সামনে নিয়ে যেতে পারেন। আমার কাছে মেধাবীর অর্থ হলো, যে নতুন কিছু তৈরি করতে পারে, যা যেকোনো সমাজের জন্য ভালো। একজন মেধাবী শিল্পী হলেন তিনি, যিনি শিল্পে নতুন কিছু যুক্ত করার ক্ষমতা রাখেন, একজন মেধাবী অর্থনীতিবিদ হলেন তিনি, যিনি আমাদের প্রয়োজনের মতো নতুন ফর্মুলা বের করতে পারেন। আমার কাছে একজন মেধাবী ডাক্তার হলো তিনি, যিনি আমাদের জন্য টেকসই নতুন কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি বের করতে পারেন, একজন মেধাবী প্রকৌশলী এই দেশের জন্য টেকসই ব্রিজ কিংবা রাস্তা বানাতে পারেন, একজন মেধাবী আইনজীবী হলেন তিনিই, যিনি আমাদের জন্য উপকারে আসে- এমন আইন তৈরিতে সাহায্য করতে পারেন।
বাকিরা হলেন দক্ষ, যারা কোনো কিছু ভালো করে শিখে সেটাকে কাজে লাগাতে পারছেন। তার বাইরে রয়ে গেছে অসংখ্য অদক্ষ মানুষ, যারা হয়তো এই গ্রহের জন্য অপাঙতেয়ও হয়ে যেতে পারেন।
দুই.
একটি সমাজ হলো পিরামিডের মতো। ইংরেজিতে একটা কথা প্রচলিত আছে- ইউ আর লোনলি অ্যাট দ্য টপ- অর্থাৎ ওপরে আপনি একা। আপনি যখন খুব ওপরে ওঠে যাবেন (যেকোনো ক্ষেত্রে), আপনি সব সময়ই একা হয়ে যাবেন। পিরামিডের শীর্ষে আপনি একা। তার নিচের ধাপে থাকে অল্প কিছু মানুষ। তার নিচে আরো বেশি। এবং সবার নিচে থাকে বিশাল জনগোষ্ঠী।
পিরামিডের ওপরের অংশটাই পরিচালনা করে একটি দেশ কিংবা সমাজ। মাঝখানের একটি বড় অংশ মিডল ক্লাস (সেটা মেধা, দক্ষতা এবং সম্পদ- সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য)। তার নিচে আপামোর মানুষ। তারা যে সব সময় দরিদ্র, তা কিন্তু নয়। তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে এবং চিন্তাচেতনাও নিচের স্তরে। আমেরিকার নির্বাচনে নিশ্চই সেটা পুরো বিশ্ব দেখেছে!
একটি জাতিতে যখন অনেক মেধাবী মানুষ থাকবে এবং সমাজ যখন তাদের ওপরের দিকে ধরে রাখতে পারবে- তখন তারা যেভাবে সমস্যাগুলোর সমাধান দিতে পারবে- মেধাহীন মানুষদের সেটা পারার কথা না। মেধাহীন মানুষ যখন ওপরের স্তরে চলে যাবে, তখন বুঝতে হবে কোথাও বড় ধরনের ঝামেলা হয়ে গেছে। মেধাহীন মানুষগুলোর প্রতিনিয়ত ষাঁড়ের মতো হুংকার অন্যদের জন্য বিব্রতকর। কারণ, সে জানেই না যে কী জানে না। তাই তাদের চিন্তা ভিন্ন হবে, তাদের কর্মকাণ্ড ভিন্ন হবে, তাদের ব্যবহার ভিন্ন হবে। একটা সময়ে পুরো পিরামিডটা ভেঙে পড়বে।
সমাজের এই যে স্ট্রাকচার- এটা আমরা অনেকেই জানি। তবু ডকুমেন্টেশনের কারণে এখানে লিখে রাখলাম।
তিন.
এই বাংলা যে একসময় খুব সম্পদশালী ছিল, এটা অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেন না। একটা সময়ে পুরো পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশ জিডিপি ছিল আওরঙ্গজেবের হাতে- এটা অনেকেই বিশ্বাস করছেন না। এই বাংলা এতটাই সম্পদশালী ছিল যে, এখান থেকে কর আদায় করার জন্য সম্রাট আকবর বাংলা ক্যালেন্ডার তৈরি করেন। সেখান থেকেই বাংলা নববর্ষ চালু।
বাংলা ছিল আওরঙ্গজেবের আয়ের একটি বিরাট অংশ। আঠারো শত শতাব্দীতে বাংলা (বেঙ্গল সুবাহ) ছিল ভারতবর্ষের সবচেয়ে সম্পদশালী এবং শিল্পোন্নত স্থান। তখন বাংলাকে বলা হতো ‘পারাডাইজ অব নেশনস’। এর অধিবাসীদের আয় ছিল পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। পৃথিবীর মোট জিডিপির শতকরা ১২ ভাগ ছিল বাংলার। সিল্ক, কটন, টেক্সটাইল, স্টিল, কৃষি- সবই রপ্তানি হতো এই দেশ থেকে। ঢাকা ছিল তখন তাদের রাজধানী। ঢাকার মসলিনের কথা সারা পৃথিবী জানত। এই কথাগুলো আজকে অনেকের কাছেই স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হয়েছে। কারণ, আজ আমাদের বেঁচে থাকার জন্য যে পরিমাণ স্ট্রাগল করতে হয়, সেখানে ওই সময়টাকে স্বপ্ন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।
এটাও ঠিক, আমরা আমাদের সম্পদকে ধরে রাখতে পারিনি। কিন্তু কেন?
আমি আমার একটা বিশ্লেষণ দিচ্ছি। এটা খুব সঠিক না-ও হতে পারে। ইতিহাসবিদরা আরো ভালো বলতে পারবেন।
ব্রিটিশদের আসার আগে বাংলা আসলেই সম্পদশালী ছিল। তবে বাংলার মানুষ খুবই শান্তিপ্রিয় ছিল। কৃষি এবং অন্যান্য বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করতে শিখলেও তারা সামরিক খাতে ব্যয় করেনি। নিজের সম্পদ রক্ষার জন্য যে যথেষ্ট সামরিক বাহিনীর প্রয়োজন হয়, সেটা তারা বুঝতে পারেনি। তাই বাংলা বারবার অন্যরা দখল করে নিয়েছে। এটা ছিল বাংলার জন্য ভুল স্ট্রাটিজিক পদক্ষেপ। তত দিনে অন্য রাষ্ট্রগুলো সম্পদ আহরণের জন্য তাদের সীমানার বাইরে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের কাছে আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র ছিল। তার তুলনায় বাংলার কাছে কিছুই ছিল না। ফলে বাংলা তার সম্পদ রক্ষা করতে পারেনি। মোগল এবং ব্রিটিশরা তো আমাদের শোষণ করেছেই, অনেক ক্ষেত্রে আমাদের কর্মীদের হাত কেটে দিয়েছে; শিল্পকারখানাকে পঙ্গু করার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে, বাংলাকে কায়দা করে দুভাবে ভাগ করে দিয়ে গেছে।
১৭৫৭ সাল থেকে আমরা ক্রমাগত সম্পদহীন জাতিতে পরিণত হতে থাকি। আপনি যদি আমেরিকার শক্তির দিকে তাকান, তাহলে দেখুন তার সামরিক শক্তি কতটা। আজ চীন যে ছড়ি ঘুরাচ্ছে, দেখুন তার সামরিক শক্তি কতটা। গত কয়েক শতকে যারা এই গ্রহের সম্পদকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তারা যুদ্ধ করেই সেটা করেছে। এবং সেটা এখনো বিরাজ করছে।
তবে এই শতাব্দীতে এসে যুদ্ধের ধরন পাল্টেছে। সে এক নতুন ধরনের যুদ্ধ। কঠিন যুদ্ধ! বুদ্ধিমত্তার যুদ্ধ! এখন আর সবক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী পাঠাতে হয় না। দূরে বসেই সম্পদ আহরণ করা যায়। আমাজন, গুগল, ফেসবুক, অ্যাপল, নেটফ্লিক্স ইত্যাদি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশ থেকে প্রচুর সম্পদ নিয়ে যায়। আমরা বুঝতেই পারি না। কিছু বুঝতে পারি, কিন্তু কীভাবে ঠেকাব, সেটা জানি না। এমন আরো অসংখ্য উদাহরণ আছে। এগুলো বোঝার জন্য এবং নিজেদের সম্পদ ধরে রাখার জন্য মেধা লাগবেই। এ ছাড়া আগামী ২০ বছর অনেক কিছুই হারাব, যা তখন গিয়ে টের পাব।
চার.
কয়েক বছর আগে আমি আমার এক বন্ধুর কাছে থেকে একটি জিনিস শিখেছি। সেটা পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করা যেতে পারে।
আমার ওই বন্ধুটি কিছুদিন ওয়ার্ল্ডব্যাংকের একজন বিদেশি উপদেষ্টার সঙ্গে কাজ করছিল। তার নাম জর্জ। আমরা সবাই জানি, এই দেশে যারা উপদেষ্টা হিসেবে আসে, তাদের বেশি ভাগেরই যোগ্যতা ততটা থাকে না। এই দেশে কাজ করার জন্য তাদের সাধারণ বেতনের পাশাপাশি আরো বাড়তি টাকা দিতে হয় (যেহেতু তারা দরিদ্র দেশে কাজ করতে এসেছে)।
জর্জের বিষয়ে মোটামুটি সবাই খ্যাপা। জর্জ কারো কথাই শোনে না। তার ইচ্ছেমতো একটা প্রেসক্রিপশন দিয়ে বলে, ‘পারলে এটা করো, নইলে নাই। এটা নিয়ে আর বেশি কথা নয়।’ মোট কথা, তার উপদেশমতোই প্রকল্প করতে হবে- সেটা আমাদের কাজে লাগুক আর নাই লাগুক!
আমার বন্ধুটি সেটা কিছুতেই মেনে নেবে না। সে একদিন জর্জকে বলল, ‘শোনো জর্জ, তুমি যা বলছ এগুলো তো আমাদের কোনো কাজে লাগবে না, টাকাটাই নষ্ট হবে। তুমি একটু খুলে বলবে, কেন তুমি এমন করছ? কেন তুমি আমাদের কথা শুনছ না? তোমার তো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। আমরা তোমাদের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছি। কিন্তু আমাদের তো আমাদের মতো সমাধান করতে দেবে, নাকি?’
জর্জ কোনো উত্তর দেয় না। আমার বন্ধুটি তখন বলেই বসল, ‘তুমি আমাকে এটা না বুঝিয়ে বললে আমি কিন্তু এই প্রকল্প পাস করব না। তোমাদের টাকা নেব না। যা হবার হোক!’
নাছোড়বান্দা দেখে জর্জ তাকে যা বলল, ‘শোনো, আমি হলাম আমার দেশের মধ্যম টাইপের মানুষ। আমার চেয়ে হাজার হাজার স্মার্ট মানুষ আমার দেশে কাজ করে। এরা কেউ এখানে আসবে না। আমার মতো একজন মানুষ যখন তোমাদের সঙ্গে বসি, তখন টেবিলের উল্টো পাশে যারা বসে থাকে, তাদের জ্ঞানের গভীরতা দেখে আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার এটা পানিশম্যান্ট পোস্টিং। নিজের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করে পরে ঠিক করেছি, এদের সঙ্গে কথা বাড়িয়ে লাভ নাই। তাই একটা কিছু ধরিয়ে দিই। করলে করো, নইলে নাই।’
আমার বন্ধুটি জবাব দিল, ‘আমরা পারি না বলেই তো তোমাকে উপদেষ্টা করা হয়েছে। তুমি সমাধান করে দেবে।’
জর্জ মুচকি হাসতে হাসতে বলল, ‘আমাকে কি পাগলা কুকুরে কামড়িয়েছে যে আমি তোমাদের সমস্যার সমাধান করতে যাব। তোমরা তোমাদের সমস্যার সমাধান করবা। তোমরা সেটার জন্য এখনো প্রস্তুত না। তুমিই একমাত্র মানুষ যে বলল, প্রজেক্ট নিবা না। বাকিরা তো টাকা নিতে পারলেই খুশি। প্রজেক্ট কোথায় গেল, সেটা বোঝার মতো জ্ঞানটুকু তো থাকতে হবে! তোমাকে বুঝতে হবে, টেবিলের ওপাশে কার সঙ্গে তুমি কাজ করছ!’
জর্জের কাছ থেকে আমরা দুজনেই শিখলাম, টেবিলের ওপাশে কার সঙ্গে আমি কথা বলছি! সে কি একজন স্মার্ট মানুষ? সে কি আলোচনার বিষয়বস্তুটা বোঝে? সে কি জানে, কীভাবে পাল্টে যাচ্ছে পৃথিবী? নাকি এমনি এমনি বলে, কিছুদিনের মধ্যেই সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে বাংলাদেশ?